বিগত কয়েক মাস ধরে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। প্রতিদিনই আত্মহননের নিষ্ঠুর সংবাদগুলো পাওয়া যায়। গত জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে শিশুসহ ৪ জন গলায় ফাঁস ও কীটনাশক পান করে আত্নহত্যা এবং ৪১জন শিশু-নারী আত্নহত্যার চেষ্টা করেছেন। গত (২০ সেপ্টেম্বর) পরোকিয়ায় স্ত্রী প্রেমিকার সাথে চলে যাওয়ায় আলোনিয়া গ্রামের মো সোগাগ (৩২) নামের স্কুল শিক্ষক ও স্বামীর সাথে অভিমান করে মাকসুদা আক্তার (১৮) নামে রায়পুরের উদমারা গ্রামের এক গৃহবধু কীটনাশক পানে আত্নহত্যার চেষ্টা করে। গৃহবধুর অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় তাকে ঢাকা হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছিলো।
বিশেষজ্ঞরা জানান, যখন কোনো ব্যক্তির জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক ও উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজেকে অসহায়-ভরসাহীন মনে করে, তখনই ধর্ম-কর্ম ভুলে মানুষ আত্মহত্যা করে বসে। প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপও আত্মহত্যার পেছনে কাজ করে। আবার জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে আত্মরক্ষা করতে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিরা আত্মহননের মধ্য দিয়ে মুক্তি খোঁজে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জুলাই মাসে ১৪ জন, আগষ্ট মাসে ১৬ ও সেপ্টেম্বর মাসে ১১ জন কীটনাশক পান করে আত্নহত্যার চেষ্টা চালায়। তাদের মধ্যে গত (২৯ জুলাই) রায়পুরের রাখালিয়া গ্রামের প্রবাসীর ছেলে আহত শিশু হিমেল (৮) টিকটক করতে না পেরে গলায় মায়ের ওড়না পেঁচিয়ে, (২৭ আগষ্ট) প্রেমিকা বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় বাসটার্মিনাল এলাকায় এক বাসায় পান্না আক্তার মনি নামের এক গৃহকর্মী গলায় ফাঁস দিয়ে, ২৩ আগষ্ট-উত্তর চরবংশি গ্রামের প্রবাসীর গৃহবধু মিতা আক্তার (২০) তার স্বামীর সাথে অভিমান করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তাদের বাড়িতে এবং (১২ সেপ্টেম্বর) প্রেমিকা বিয়ে করতে না করায় ঢাকা নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারের শিখনকান্দা গ্রামের কলেজ ছাত্র মোঃ শরিফ হোসেন অভিমান করে রায়পুরের বাসটার্মিনাল এলাকায় মৃত্যু হয়।
গত তিন মাসে রায়পুর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান, মোঃ নাইম (১৮), হ্যাপি (২৩) , জাকিয়া (১৯),পারভিন আক্তার (৪২), আনিসুর রহমান (২১), সফিক মিয়া (৪৫), সাথি বেগম (২০), সাগর (২২), পারভেজ হোসেন (২৫), সুমা আক্তার (২৭), শাহনাজ (১৬), কিরন (১৩), মোঃ জীবন (২০), মারুফ হোসেন (১৩), মৌসুমি (২৫), কাকলি (১৬), মোঃ জহির (৩৭), রিমি আক্তার (১৭), লামিয়া (১৫), শান্ত (১৯), জহির (১৯), শান্ত হোসেন (২৪), সোহাগী বেগম (২০), রুমা (২৫), ফয়সাল (৪৪), পারভিন আক্তার (১৭), অন্তর হোসেন ( ১৮), সুমাইয়া আক্তার (২৯), রাবেয়া (২৭), রেশমা (২০), মাকসুদা আক্তার (১৮) ও সোহাগ হোসেন (৩২), ইমাম হোসেন (১৬), জয়নাব (১৭), পিংকি (২১), আবদুল্লাহ (৩৪), সাজু মিয়া (২৫) সহ ৪১ জন।।
বর্তমানে ১০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হল আত্মহত্যা। অধিকাংশ তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার ঘটনা আবেগতাড়িত। হতাশা, অভিমান, প্রেমে ব্যর্থসহ ছোটখাটো বিষয়েই আবেগতাড়িত হয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেন। নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এ পেছনে রয়েছে নির্যাতন, ইভটিজিং, যৌতুক, অবমাননা ইত্যাদি। আত্মহত্যার ঘটনা প্রচার হলে বা কেউ প্রত্যক্ষ করলে অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের ৯৫ ভাগই কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভোগেন।
প্রবাসীর স্ত্রী গৃহবধু রুমি বেগম বলেন, আমার শিশু সন্তান মোবাইলে আশক্ত হয়ে পড়েছিলো। টিকটকে কিভাবে আত্নহত্যা করে তা রাতে দেখে পরদিন সকালে স্বীদ্ধান্ত নেয় সেও ওই আত্নহত্যার অভিনয় করবে। কিন্তু তাকে মোবাইল না দেয়ায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে জানালার সাথে আত্নহত্যা করে। তার ভিতরে হতাশা ও অভিমান কাজ করেছিলো।
বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও-রায়পুর সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ইয়াসিন মাহমুদের কথায়, মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি থাকে, যেমন- বিষণ্ণতা, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্ত, উদ্বেগে আক্রান্ত ইত্যাদি রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার উচ্চ। বিষণ্ণতার রোগীদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র আশাহীনতা তৈরি হয়। দুনিয়ার সবকিছু তারা নেতিবাচকভাবে দেখে। তারা নিজের সম্পর্কে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ও অন্য মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা পোষণ করে। তারা ভাবে, পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হবে। এটি পরিবর্তনের জন্য শত চেষ্টায়ও কোনো লাভ হবে না। এর চেয়ে মুক্তির উপায় নিজেকে মেরে ফেলা। এ চিন্তায় তাড়িত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে। পারিবারিক কলহের কারণেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বিষণ্ণতা, একাকিত্ব কিংবা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। যেমন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হলে, বিশ্বাস না থাকলে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ অন্য কোনো নারী-পুরুষে আসক্ত হলে মানসিক অশান্তি থেকে রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের পরিবারের সন্তানা মানসিকভাবে অসুস্থ।
লক্ষ্মীপুর সিভিল সার্জন আহম্মেদ কবির বলেন, বর্তমান সময়ে মানসিক অশান্তি, একাকিত্ব বা বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা রায়পুরে সবচেয়ে বেশি ঘটছে। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে মনে করছি।