প্রখ্যাত গীতিকবি, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান অনেক কালজয়ী বাংলা গানের এই স্রষ্টা।
‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’সহ বহু কালজয়ী গানের রচয়িতা তিনি। তাঁর ঝুলিতে আছে আরো গান—‘অনেক সাধের ময়না আমার, বাঁধন কেটে যায়/মিছে তারে শিকল দিলাম, রাঙা দুটি পায়। ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা/উড়েছে পাখি পথ অচেনা। ’ গতকাল যেন সব বাঁধন কেটে অচেনা পথে পাড়ি জমালেন এই শিল্পী।
সিনেমার অসংখ্য কালজয়ী গানের রচিয়তা এই কিংবদন্তি চিত্রপরিচালক হিসেবেও পেয়েছেন খ্যাতি।
কাজের সুবাদে জীবদ্দশায় বহুবার (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে ( বিএফডিসি) আসতে হয়েছে তাকে। তার আনন্দ-বেদনার বহু স্মৃতি ছড়িয়ে এই চলচ্চিত্রের সূতিকাগারে।
সোমবারও (৫ সেপ্টেম্বর) গাজী মাজহারুল আনোয়ার এলেন এফডিসিতে, কিন্তু শেষবারের মতো। কারণ জাগতিক সকল বন্ধন ছিন্ন করে তিনি বিদায় নিয়েছেন। এদিন দুপুর সাড়ে বারোটায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ এফডিসিতে নিয়ে আসা হয়। তার জন্য তৈরি করা হয় বিদায় মঞ্চ।
মরদেহ এফডিসিতে পৌঁছানোর পর একে একে তাকে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের মানুষেরা ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান।
স্মৃতিচারণ করে সঙ্গীতশিল্পী মনির খান বলেন, এমন কোনো দিন নেই ওনার সঙ্গে আমার কথা হতো না। তার স্নেহে আমি বড় হয়েছে। গাজী চাচার শেষ ইচ্ছে ছিল, ওনার ২০ হাজারেরও বেশি গানের কপিরাইট করা। যাতে এসব গান তার পরিবার বা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারে।
প্রিয় মানুষটিকে শেষবার এক নজর দেখার জন্য আসেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস। তিনি বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মতো মেধাবী আর কখনো ফিরে আসবেন না। তিনি খুব ভালো মনের একজন মানুষ ছিলেন। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। অনেক স্মৃতি ওনার সঙ্গে। সেসব কখনো ভোলা সম্ভব না।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ছিলেন একজন কিংবদন্তি। তাঁর গানের জন্য বহু চলচ্চিত্র সুপাহিট হয়েছে। চলচ্চিত্রের ওনার অবদান কখনো ভোলার নয়।
গাজী মাজহারুলকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, বাংলাদেশ সিঙ্গার অ্যাসোসিয়েশন, গীতিকবি সংঘসহ বেশকিছু সংগঠন।
বাদ যোহর এফডিসিতে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার মরদেহ রাজধানীর চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে জানাজার জন্য তাকে নেওয়া হবে গুলশানের আজাদ মসজিদে। এরপর বনানী কবরস্থানে বাদ আসর মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে এই কিংবদন্তিকে বলে জানা গেছে।

পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। চিকিৎসকের পরামর্শে শনিবার তাঁর কিছু ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়। গতকাল আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ছিল। কিন্তু ভোরবেলায় অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। দায়িত্বরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
দুপুরে হাসপাতালে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ছেলে সরফরাজ আনোয়ার উপল সাংবাদিকদের জানান, আজ সোমবার সকাল ১১টায় মরহুমের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নেওয়া হবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। সেখানে দুপুর ১টায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আসরের নামাজের পর গুলশান আজাদ মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা হবে। এরপর বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত হবেন মাজহারুল আনোয়ার।
সাতচল্লিশের দেশবিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন করে সংগীতের চর্চা, প্রচার ও প্রসারের আয়োজন শুরু হয়। এ সময়ের আধুনিক গানের বাণী ও সুর রচনায় যাঁরা মৌলিকত্বের পরিচয় দেন, তাঁদের মধ্যে গাজী মাজহারুল আনোয়ার অন্যতম। তাঁর রচিত গানের বাণী ও সুরে পূর্ববর্তী আধুনিক বাংলা গানের ধারা অনুসৃত হলেও সাংগীতিক চলনে ও গঠনে ভিন্ন স্বাদের অবতারণা সুস্পষ্ট। তাঁর গানে দেশপ্রেমের পাশাপাশি মানব-অনুভূতির নিগূঢ়তম তলদেশ খুঁজে পাওয়া যায়।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার তালের ছেও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশকের শুরুতে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনা শুরু করলেও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে গান লেখার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর প্রধানত গান আর চলচ্চিত্র ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে তাঁর জীবন।
১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ চলচ্চিত্রে ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গান লেখার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে গীতিকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের। প্রথম গানেই শ্রোতাদের মন জয় করেন তিনি। এরপর বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে সৃজন আনন্দে অবিরাম ধারায় মণি-মুক্তা বিলিয়েছেন। উপহার দিয়েছেন ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ইশারায় শিস দিয়ে ডেকো না’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে’-এর মতো বহু স্মরণীয় গান। তাঁর নিজের লেখা ‘অল্প কথার গল্প গান’ বইয়ের ভূমিকা ও পরিচিতি অংশে বলা হয়েছে, ৬০ বছরের কর্মজীবনে তিনি ২০ হাজারের বেশি গান উপহার দিয়েছেন।
স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সারা দেশ তেতে আছে। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের ৭ই মার্চের ভাষণে ঘোষণা দিয়েছেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ওই আন্দোলনঘন সময়েই ‘জয় বাংলা’ নামের একটি সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা আসে। সিনেমাটির জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বক্তব্য ধারণ করে গাজী মাজহারুল আনোয়ার লেখেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। আনোয়ার পারভেজের সুরে এই গানকেই পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। সূচনা সংগীত হিসেবে প্রতিদিন নিয়মিত প্রচার করা হতো গানটি।
২০০৬ সালে শ্রোতাজরিপের ভিত্তিতে বিবিসি বাংলা তৈরি করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের তালিকা। এতে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ ও ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ গান তিনটি স্থান পায়। গান তিনটি তালিকায় যথাক্রমে ১৩, ১৫ ও ১৯ নম্বরে স্থান পায়।
কর্মজীবনের শুরুতেই প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক সত্য সাহার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ ঘটে তাঁর। গাজী মাজহারুল আনোয়ার কিছু টিভি নাটকও পরিচালনা করেছেন। তাঁর প্রযোজিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৩১। পরিচালনা করেছেন ২১টি চলচ্চিত্র। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক ছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ছয়বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সংগীত বিষয়ে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্ত্রী জোহরা গাজী, পুত্র সরফরাজ মেহেদী আনোয়ার উপল, কন্যা দিঠি আনোয়ারসহ অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব ও ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন।
শোক : গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহ্মুদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা শোক জানিয়েছেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।