মেঘনা উপকূলীয় লক্ষ্মীপুরের সদর থেকে রামগতি আঞ্চলিক সড়কের পাশে ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি নিলাম প্রক্রিয়ার জন্য ওই গাছগুলোর গায়ে ‘নাম্বারিং’ করাও হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষ হলেই এ বিপুল পরিমান গাছ কাটাও পড়বে।
একদিকে তীব্র দাবদাহ থেকে মুক্তি পেতে সরকার সারাদেশে গাছ রোপণের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। অপরদিকে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন সড়ক প্রশস্তকরণের নামে চলছে গাছ ‘হত্যার’ আয়োজন।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর, রামগতি ও রামগঞ্জ উপজেলার ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে গাছগুলোর নাম্বারিং শেষ হয়েছে। নিলাম প্রক্রিয়া শেষ হলেই সদর-কমলনগর ও রামগতি উপজেলার লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের পাশের ১৩ হাজার ৪৪৫টি, রামগতি উপজেলার বিভিন্ন সড়কের ১ হাজার ৬৭২টি ও রামগঞ্জে ১২৫টি গাছ কাটা হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সুপারিশের প্রেক্ষিতে জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি গাছগুলো কাটার অনুমোদন দিয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, ২০০৫ সালে বনবিভাগ লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের দু’পাশে বিভিন্ন ফলদ-বনজ ও ওষুধী গাছগুলো রোপণকরে। গাছের ছায়ার কারণে এ সড়কটি সবসময় শীতল আবহে থাকে। এছাড়াও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ নানা উপকারে আসে গাছগুলো। প্রায় ১৯ বছরে গাছগুলো পরিপক্ব হয়েছে। ডালপালার প্রসার ঘটে সবুজ-শ্যামল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন এ সড়কে যাতায়াত করে।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, উন্নয়নের নামে প্রায় ৫ বছর আগে রায়পুর-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের দুইপাশে থাকা শতবর্ষীসহ দুই হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। একইভাবে ২০২০ সালে লক্ষ্মীপুর-ভোলা-বরিশাল জাতীয় সড়কের (মজুচৌধুরীর হাট সড়ক) পাশের থাকা প্রায় ৫ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এখন এ দুটি সড়কে বড় কোনো গাছ নেই। সম্প্রতি মজুচৌধুরীর হাট সড়কের একটি অংশে বনবিভাগ কিছু গাছ লাগিয়েছে। তবে রায়পুর-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী সড়কের লক্ষ্মীপুর জেলা অংশে এখনো কোনো গাছ লাগানো হয়নি। এসব সড়কে যাতায়াতে প্রচণ্ড দাবদাহ সহ্য করতে হয় পথচারীসহ যানবাহনের যাত্রীদের। তবে সওজ সড়কের পাশে বনায়নের অনুমতি দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ বনবিভাগের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার সংযোগকারী সড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় লক্ষ্মীপুর সড়ক বিভাগের আওতাধীন লক্ষ্মীপুর-চর আলেকজান্ডার-সোনাপুর-মাইজদী সড়কটি ৫.৫০ মিটার থেকে ৭.৩০ মিটার প্রশস্ততায় সম্প্রসারণ করা হবে। লক্ষ্মীপুর অংশে (লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক) ৫৪ কিলোমিটার সড়কে বনবিভাগের লাগানো গাছ রয়েছে। সেগুলো কাটার জন্য বনবিভাগকে গত বছর নভেম্বরে লক্ষ্মীপুর সওজ বিভাগ চিঠি দেয়। এ সড়কে ২০০৫ সালের দিকে বনবিভাগের রোপন করা গাছের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৪৫টি।
এদিকে ২০১২ ও ২১ সালে রামগতি উপজেলার নুরিয়া হাজিরহাট-নুরু পাটওয়ারী সড়কের কেরামতিয়া বাজার থেকে ভুলুয়া ব্রিজ ও পূর্বদিকে চৌরাস্তা হয়ে জোরি মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে গাছ রোপণ করেছিল বনবিভাগ। এ সড়কের ১৬৭২টি গাছ কাটার জন্য গত বছরের ডিসেম্বরে বনবিভাগকে চিঠি দেয় এলজিইডি।
অন্যদিকে রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া বাজার থেকে লামচর উচ্চ বিদ্যালয় ও আজিমপুর থেকে করপাড়া পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়কে বন বিভাগের ১৮৭ গাছ রয়েছে। সড়কটির উন্নয়নে ১২৫টি গাছ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে জানায় এলজিইডি। এতে গত বছর সেপ্টেম্বরে বন বিভাগকে গাছগুলো কাটার জন্য চিঠি দেওয়া হয়।
স্কুলশিক্ষক সানা উল্যাহ সানু বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লক্ষ্মীপুরে প্রাকৃতিক দূর্যোগ লেগেই থাকে। এরথেকে উত্তরণে বেশি করে গাছ লাগানো প্রয়োজন। কিন্তু উন্নয়নের নামে সড়কের পাশের গাছগুলো কাটায় তীব্র দাবদাহ বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়-জলচ্ছ্বাসের ঝুঁকিও।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, সারাদেশে ২৫ ভাগ বনায়নের স্থলে আমাদের রয়েছে ১৬ ভাগ। এরমধ্যে নানা অজুহাতে প্রতিনিয়ত গাছ কাটা হচ্ছে। একটি গাছ কাটা হলে দুটি রোপণ করার কথা থাকলেও করা হচ্ছে না। গাছ না থাকলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাবে। একপর্যায়ে অক্সিজেনের অভাবে বায়ুমণ্ডলে বিরুপ প্রভাব পড়বে। এর থেকে রক্ষায় গাছ কাটা কমাতে হবে।
লক্ষ্মীপুর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ফিরোজ আলম চৌধুরী বলেন, সওজ বিভাগের সিদ্ধান্তে গাছগুলো কাটা পড়বে। এরজন্য বনবিভাগ সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না। তীব্র দাবদাহ থেকে মুক্তি পেতে গাছ লাগানোর বিকল্প নেই। যেখানে গাছ কাটা পড়ে, সেখানে নতুন করে গাছ লাগানো হয়। তবে সওজ বিভাগ গাছ কাটার পর সড়কের পাশে পুনরায় লাগাতে দেয় না।
লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, সড়ক সম্প্রসারণের জন্য গাছ কাটতে সুপারিশ করা হয়েছে। গাছের কারণে রোদ না পড়ায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সড়কের কাজ শেষ হলে দু’পাশে ফলদ গাছ লাগানো হবে। মন্ত্রণালয় থেকে নতুন নির্দেশনা থাকায় বনবিভাগকে গাছ লাগাতে দেওয়া হচ্ছে না।
জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি এবং জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, গাছ কাটার প্রক্রিয়ার বিষয়টি এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। সড়ক প্রশস্ত হলে এলাকার উন্নয়ন হয়। সড়ক উন্নয়নের পর গাছ লাগানো হয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর পাশে বিপুল সংখ্যক গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া বনবিভাগের সঙ্গে সওজ বিভাগের গাছ লাগানো নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও মাসিক সমন্বয় সভায় নিরসন করা হবে।