চন্দ্রগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের বহিস্কৃত আহ্বায়ক কাজী মামুনুর রশিদ বাবলু ওরফে কাজী বাবলুর রাজনৈতিক উত্থানে তার শত কৌশলের মধ্যে অন্যতম একটি কৌশল ছিল প্রতিপক্ষকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা। নিজ দল বা ভিন্ন মতের যেই হোক তাকে থানা পুলিশের সহযোগিতায় অথবা আদালতে নিজের অনুগত আইনজীবীদের ব্যবহার করে মামলায় জড়ানো হতো। এর মধ্যে আলোচিত একটি মামলা ছিল, কাজী বাবলুর আপন ভাগিনা রবিউল আউয়াল শিমুল হত্যাকান্ড। শিমুল প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। শৈশবেই শিমুলের মা’ মারা যায়। মায়ের মৃত্যুর পর শিমুল মামা কাজী বাবলু ও কাজী মোস্তফা কাজলের কাছে বড় হয়।
সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জে বহুল আলোচিত সমালোচিত দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান বাহিনীর প্রধান জিসান ও নাছির বাহিনীর প্রধান নাছিরের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সাপে নেউলে। একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে প্রতিনিয়ত চলতো গোলাগুলি, দাঙ্গা, হাঙ্গামা। একপক্ষ আরেক পক্ষের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগের মত ঘটনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
ফিরে দেখা ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল :
২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল রাতে কী ঘটেছিল। রাত তখন ৯টা। লক্ষ্মীপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী পশ্চিম লতিফপুর গ্রামের সোলেমান উদ্দিন জিসান বাহিনীর সঙ্গে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী দেওপাড়া গ্রামের নাছির বাহিনীর প্রধান নাছিরের মধ্যে দফায় দফায় গুলি বিনিময় এবং বসতবাড়িতে পাল্টাপাল্টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ওই সময় দু’পক্ষের গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কাজী বাবলুর ভাগিনা স্কুলছাত্র রবিউল আউয়াল শিমুল মামার বাড়ি সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় এবং বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহম্মদের বাড়িতে তার বসতঘরে বাইরে থেকে তালা আটকিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হলে আগুনে পুড়ে মারা যায় ফরহাদ হোসেন নামে এক যুবক। নিহত ফরহাদ হোসেন সম্পর্কে তোফায়েল আহম্মদের নাতি হয়। ওইদিন রাতে তোফায়েল আহম্মদের বাড়ি ছাড়াও যুবলীগ নেতা গৌতম মজুমদার, বিএনপি নেতা আলী করিমের বাড়িসহ আরো বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল।
তবে, শিমুল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাস্থল এলাকা ছিল নাছির বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ওই রাতে দুই সন্ত্রাসী বাহিনীর গোলাগুলিতে দুইপক্ষের অন্তত দুই থেকে তিনশ’ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অংশ নিয়েছিল। এই ঘটনার ১৪ দিন পর ভাগিনা শিমুলের হত্যা মামলা দায়ের করেন মামা কাজী বাবলু।
৬ বছর পর পিবিআইতে মামলার তদন্ত :
এই মামলা দায়েরের পর ৬ বছরেও তদন্তে কোনো কুল কিনারা করতে পারেননি তদন্ত সংস্থাগুলো। কোন পক্ষের গুলিতে শিমুল মারা গেছে, প্রকৃতপক্ষে আসলে কারা হত্যাকারী? এসবের কোনো সুরাহা করতে না পেরে থানা পুলিশ ও ডিবির তদন্তে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। কিন্তু, কাজী বাবলু এসব রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবারই অনাস্থা দেয়। সবশেষ ২০১৯ সালের শেষের দিকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নোয়াখালী সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। পরে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর আদালতে ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। খালাস দেওয়া হয় এই মামলার সবচেয়ে আলোচিত আসামি তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু ভূঁইয়াকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকেই কাজী বাবলু তার ভাগিনা হত্যার ঘটনাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। ভাগিনার খুনের বিচার প্রাপ্তির চেয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। এর ধারাবাহিকতায় স্থানীয়ভাবে দলীয় গ্রুপিংয়ের অংশ হিসেবে তাজুল ইসলাম তাজু ভূঁইয়ার সাথে কাজী বাবলুর বিরোধ ছিল। পিবিআইর তদন্তকালে কাজী বাবলু প্রায়সময় নিজদলের অনেককে ভাগিনা হত্যায় আসামি করার হুমকি দিত। যার কারণে, অনেকেই ভয়ে কাজী বাবলুর বিরুদ্ধাচরণ করতো না। কিন্তু; তাজু ভূঁইয়ার সাথে বিরোধের অংশ হিসেবে সবশেষ তাকে এই মামলার চার্জশীটে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আদালতে চার্জশীট দাখিলের পর স্বাক্ষ্য গ্রহণকালে তাজু ভূঁইয়াসহ সকল আসামির বিরুদ্ধে কাজী বাবলুসহ তার নিয়োজিত স্বাক্ষীরা স্বাক্ষ্য দেয়। পরে, রাজনৈতিকভাবে তাজু ভূঁইয়ার সাথে সমঝোতা হলে পুনরায় আদালতে স্বাক্ষী রিকল দিয়ে তার পক্ষে স্বাক্ষী দেওয়া হয়। যার ফলে, মামলার রায়ে সাত আসামির মধ্যে ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হলেও খালাস পায় তাজু ভূঁইয়া। জানা গেছে, এই মামলা থেকে তাজু ভূঁইয়াকে খালাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৬ লক্ষ টাকা নিয়েছেন কাজী বাবলু।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত ১৫ বছরে কাজী বাবলুর রোষানলের শিকার হয়ে ১৮০ জন দলীয় নেতা-কর্মী বিভিন্ন সময় একাধিক মামলার আসামি হয়ে জেল খেটেছেন। নিজের অনুগত বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে একই দলের প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালানো হতো কাজী বাবলুর নির্দেশে। পরে, হামলায় আহতরা মামলা করলে বাবলুও টাকা খরচ করে সদর হসপিটালের কেস স্লিপ সংগ্রহ করে কাউন্টার মামলা দায়ের করতো। এসব মামলা দায়েরে কাজী বাবলু থানা পুলিশ এবং আদালতে অঢেল টাকা ব্যয় করতো বলে জানা গেছে। কাজী বাবলুর এসব পাতানো মামলার আসামিরা এখনো আদালতে হাজিরা দেয়। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পাঁচপাড়ার ছাত্রলীগ নেতা রিয়াজ হোসেন জয়, আজিম পাটোয়ারী, নোমান, লতিফপুরের নূর হোসেন রাজু, প্রবাসে থাকা রুবেল, বাপ্পী, শেখপুরের নিশান, তার ছোট ভাই সজীব, সাধারঘরের কাউসার, ছাত্রলীগ নেতা আনসার উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা খলিল, শিপন খলিফাসহ আরো অনেক নেতা-কর্মী। এছাড়া শারীরিক নির্যাতনের চিত্র আরো ভয়াবহ। তার গ্রুপে রাজনীতি না করলেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে কয়েকশ’ কর্মী।
খেলাধূলা ও ওয়াজ মাহফিলের নামে চাঁদাবাজি :
বিভিন্ন নামে যেমন : ওয়ান নাইট, টু নাইট সর্ট পিস ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট, ব্যাড মিন্টন, ফুটবল ইত্যাদি খেলার নামে অভিনব কায়দায় চাঁদা আদায়ে কাজী বাবলুর জুড়ি নেই। ভাগিনা শিমুলের মৃত্যুর পর শিমুল স্মৃতি টুর্ণামেন্টের নামে খেলার আয়োজন করে বাজারের ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ীদের থেকে প্রতি টুর্ণামেন্টে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। অপরদিকে, কাজী বাবলুর চাঁদাবাজির আরেকটি কৌশল ছিল, বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিভিন্ন খেলার নামে এবং ওয়াজ মাহফিলের নামে ব্যবসায়ীসহ প্রবাসীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করতেন। কেউ টাকা দিতে না চাইলে ওই ব্যবসায়ীকে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। পাঁচপাড়া ছোট মিয়ার মাজারে বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল, দেওপাড়ায় বেচার বাড়িতে ওরশ মোবারক এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে বাজারে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করতেন। ৫ লক্ষ টাকা কালেকশন হলে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের দিতেন ২ লক্ষ টাকা। বাকী ৩ লক্ষ টাকা তিনি নিজেই আত্মসাৎ করার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
কাজী বাবলুর কন্টাক্ট বাণিজ্য :
টাকা হাতানোর জন্য কাজী বাবলুর বিভিন্ন অপকৌশলের মধ্যে আরেকটি ফাঁদ ছিল কন্টাক্ট বাণিজ্য। জাতীয় নির্বাচন, ইউপি নির্বাচন, বাজার কমিটি বা বণিক সমিতির নির্বাচন, স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটিসহ ইত্যাদি নির্বাচনে বিভিন্ন প্রার্থীকে নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে বিজয়ী করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রার্থীদের সাথে কন্টাক্ট করতেন। এসব কন্টাক্টে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রকারবেধে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করতেন।
পাশাপাশি কন্টাক্টে জমি দখল, দোকান দখল, বাড়ি দখল ইত্যাদি ক্ষেত্রেও কাজী বাবলুর দখল বাণিজ্য ছিল চড়াদামে। বিগত কয়েকবছরে ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী জিল্লালের দোকানঘর দখল, হান্নানের সার দোকান দখলের চেষ্টা, প্রবাসী নুরুজ্জামানের জায়গায় ঘর উচ্ছেদ, বাঁেধর গোড়ায় এবং ভবভদ্রী ব্রীজের পাশে সরকারি জায়গা দখল ও বিক্রিসহ অন্তত ৫০টি ঘটনা আছে চুক্তিভিত্তিক বাণিজ্য। আর এসব বাণিজ্যের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
বিগত, ১৫ বছরে কাজী বাবলুর অর্থনৈতিক কেলেংকারির কোনো অন্ত ছিল না। চন্দ্রগঞ্জ বাজারে অবস্থিত বিভিন্ন আন্তঃজেলা বাস কাউন্টার থেকে প্রতিমাসে কাউন্টার প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। অন্য দিকে নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কলার আড়ৎদারদের থেকে মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা আদায় করা হতো।
কাজী বাবলুর অপরাধ সাম্রাজ্যের যতগুলো প্রকাশ পেয়েছে, তার চেয়ে অপ্রকাশিত ঘটনা রয়েছে শত শত। যেসব ঘটনার কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন লিঠন ও সাধারণ সম্পাদক কাজী সোলায়মান জানিয়েছেন, কাজী বাবলু নিজে ছাত্রলীগ করলেও সে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগসহ দলের সবগুলো অঙ্গসংগঠন নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে চন্দ্রগঞ্জ বাজারসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতো। কেউ তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ ছিলনা। যার কারণে, টানা ১৫ বছর কাজী বাবলু একাই চন্দ্রগঞ্জ শাসন করেছে।
চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও চন্দ্রগঞ্জ বাজার বণিক সমিতির নেতা এম. ছাবির আহম্মেদ বলেন, কাজী বাবলুর মত অর্ধশিক্ষিত ছেলে দলের পদ-পদবী ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। নামে বেনামে তার সম্পত্তির অভাব নেই। নীরিহ একজন ফল ব্যবসায়ীর কাছে সুদে টাকা লাগিয়ে প্রতিমাসে লাখে দশ হাজার টাকা করে আদায় করেছে এই বাবলু। দশ লাখ টাকার সুদ ২০ টাকা পরিশোধ করলেও তার আসল টাকা শোধ হয়নি। পরে সুদ আসলে ওই ফল ব্যবসায়ীর বাড়ি জোরপূর্বক নিজ নামে লিখে নেয় কাজী বাবলু। ছাবির আহম্মেদ বলেন, কাজী বাবলুর মত অসৎ দুশ্চরিত্রের লোক আওয়ামী লীগ করলে এখানে ভালো মানুষেরা কখনও আওয়ামী লীগ করবে না। আমি দলের পক্ষ থেকে তার এসব অপকর্মের বিচার চাই।