আঙ্গো বাবলু ভাইর কাছে সদরের এমপি আইয়ে, রায়পুরের এমপি আইয়ে, উপজেলার চেয়ারম্যান আইয়ে। আমি ওসি সাহেবকে বলমু, ভাই এখানে ঝামেলা আছে। ওসি সাহেব পুলিশ হঞ্চাশগা পাঠাই দিবো। আরে; নেতাগিরি কইল্লে বাবলু ভাইর লগে করিয়ুম। আঙ্গো বাবলু ভাইরতোন বড় নেতা এদেশে কে আছে? তোমাদের কাছে কি অস্ত্র নাই? দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে দম্ভোক্তি করা কাজী বাবলুর এমনই একটি অডিও ক্লিপস সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন দলের কর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চন্দ্রগঞ্জে অঘোষিত সম্রাট বা মূর্তিমান আতঙ্কের একনাম কাজী মামুনুর রশিদ বাবলু ওরফে কাজী বাবলু। নানা বিশেষণ আর উপমায় অভিসিক্ত তিনি। কেউ ডাকেন ভাই, কেউ ডাকেন নেতা আবার কেউ কেউ ডাকাত বাবলু বলেও ডাকেন। ছাত্রলীগের চন্দ্রগঞ্জ থানা কমিটির আহ্বায়ক পদ ব্যবহার করে তার অনুগত ক্যাডার বাহিনীর সুবাধে তিনি এখন বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক। ব্যাংক ভর্তি টাকা, গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, নানা বৈধ-অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে রেখেছে তাকে। এ যেন এক আলাদিনের চেরাগ। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখভাল করার জন্য মাস বেতনে লোকও রেখেছেন। গড়ে তুলেছেন হাজারী স্টাইলে বেতনভূক্ত বিশ্বস্ত ষ্ট্রিয়ারিং কমিটি। এদের একেকজনকে একেক সাইডের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন তিনি।
কেউ দেখেন ইয়াবা ব্যবসা, কেউ দেখেন জেনারেটর, কেউ দেখেন রেন্ট-এ কারের গাড়ির ব্যবসা, কেউ দেখেন গ্যাস সিলিন্ডার ও দরজা গ্যালারী, কেউ দেখেন ফুটপাতের পজিশন ভাড়া এবং টাকা কালেকশন, কেউবা দেখেন দোকান ভাড়ার টাকা কালেকশন। এতসব ব্যবসার মধ্যে অভিনব এক ব্যবসা হচ্ছে ফিটিং ব্যবসা। বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্ণাঢ্য কোনো লোক চন্দ্রগঞ্জে আসলে তাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় নির্জনস্থানে। সেখানে ওই লোকের পকেটে বা হাতে ইয়াবার প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে প্রথমে ছবি তোলা হয়। এরপর বলা হয় টাকার জন্য তোর বাড়িতে ফোন কর। না হলে ইয়াবাসহ পুলিশে তুলে দিব। অসহায় এসব লোক কাজী বাবলু ও তার বাহিনীর ফাঁদে পড়ে চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়ে নিরবে বাড়িতে চলে যান। এমন অভিযোগ রয়েছে সবার মুখে মুখে।
একবার এমনই এক ঘটনায় ওসি মোক্তার হোসেন চন্দ্রগঞ্জ থানায় থাকাকালীন সময়ে তার কাছে অভিযোগ আসে। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগি লোকের কাছ থেকে নগদ ৪০ হাজার টাকা এবং ১০ লক্ষ টাকার চেক লিখিয়ে নিয়ে যায় কাজী বাবলু। পরে ওসি মোক্তার হোসেন বাবলুকে থানায় ডেকে নিয়ে গেলে সেখানে ওসির সাথে বাবলুর বাড়াবাড়ি হয়। একপর্যায়ে ওসি মোক্তার হোসেন লাঠি হাতে নিয়ে তার উপড় চড়াও হলে নগদ টাকাসহ চেক ফেরত দিতে বাধ্য হয় বাবলু।
ফিটিং ব্যবসার আরো নানা কৌশল আছে তার। যুবক-যুবতী বা প্রেমিক-প্রেমিকা চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসলে তাদেরকে বিভিন্ন মার্কেটের নির্জন জায়গায় নিয়ে বলা হয় তোরা এখানে অবৈধ কাজ করতে এসেছিস। এখন পুলিশ ডেকে এনে টু নাইনটি মামলায় ফাঁসিয়ে দেব। বেচারা প্রেমিক যুগল নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল সেটসহ সাথে যা থাকে তা দিয়ে কোন মতে জান বাঁচিয়ে পালিয়ে যায়।
আরো একটি অভিনব প্রতারণার ফাঁদ আছে কাজী বাবলুর। তা হচ্ছে, বিভিন্ন সময় ছোট-খাট ডিলার বা খুচরা ইয়াবা বিক্রেতাদের ধরে পুলিশে দিয়ে প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে বোঝায় কাজী বাবলু মাদকের বিরুদ্ধে। কিন্তু আসল ব্যাপারটি তা নয়। আসল ঘটনা হচ্ছে খুচরা বিক্রেতা যারা তার লোক থেকে ইয়াবা কিনেনা। তাদেরকে পুলিশে দিয়ে অন্যদেরকে তার লোক থেকে ইয়াবা কিনতে বাধ্য করার জন্য তার এই কৌশল।
ষ্ট্রিয়ারিং কমিটি :
কাজী বাবলুর ক্যাডার বাহিনীর মধ্যে অতি বিশ্বস্ত ১২ জনকে দিয়ে গঠন করা হয়েছে হাজারী স্টাইলে ষ্ট্রিয়ারিং কমিটি। এদের একেকজনের একেক দায়িত্ব। এর মধ্যে সম্প্রতি র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার পাঁচপাড়ার রাকিব হোসেন সুমন ও পশ্চিম লতিফপুরের আনিক রহমান, তাজু ভূইয়া, লক্ষ্মীপুরের পারভেজ, আলাইয়ারপুরের রুবেল, বসুদুহিতার আকাশ, রামকৃষ্ণপুরের অন্তর, দেওপাড়ার হৃদয় পাটোয়ারী, বালুচরার শান্ত, দেওপাড়ার এম. শাকিলসহ ১২ বার জনের ষ্ট্রিয়ারিং কমিটির এসব সদস্যরা কাজী বাবলুর অবৈধ আয়ের বিভিন্ন সেক্টরে দায়িত্ব পালন করে তারা।
গত ২০ রমজান দিবাগত রাতে চন্দ্রগঞ্জ নিউ মার্কেটের মোল্লা টেলিকম নামীয় একটি মোবাইল দোকানের সার্টারের তালা ভেঙে দুর্ধর্ষ চুরি সংগঠিত হয়। এঘটনায় কাজী বাবলুর একান্ত সহচর ও বিশ্বস্ত আন্তঃজেলা চোরচক্রের অন্যতম সদস্য আকাশ ও কাজী বাবলুর মোটরসাইকেলের চালক স্বাধীন চুরির ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। এরআগে মোশারেফ মিয়ার মুদি দোকানে চুরির ঘটনায় কাজী বাবলুর অনুগত এম. শাকিল সিসি ক্যামেরার ফুটেজে শনাক্ত হলেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগ করানো :
কাজী বাবলু যখন ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিলেন, তখন মেধা শূণ্য এবং নিজের বিকল্প যেন তৈরী না হয় সেজন্য অছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করানো ছিল তার একটি কৌশল। তার নেতৃত্বে যারা ছাত্রলীগ করতো, তাদের বেশির ভাগই অছাত্র এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শ্রমিক। টেইলার, মটর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের শ্রমিক, সিএনজি চালক, বিভিন্ন দোকানের সেলস্ম্যান তারাও ছাত্রলীগ করতো। এরমধ্যে ছাত্রলীগ নামধারী পিচ্চি একটি গ্রুপ আছে। এরা হৃদয় পাটোয়ারীর নেতৃত্বে কাজ করতো। কাজী বাবলু ইশারা দিলেই হৃদয়ের নেতৃত্বে এই পিচ্চি গ্রুপ যে কোনো লোকের উপর হামলে পড়তো।
প্রচারণায় অপকৌশল :
কাজী বাবলু ও তার বাহিনীর শত অপরাধ ঢাকতে কৌশলী বিভিন্ন প্রচারণায় অঢেল অর্থ ব্যয় করা হতো। এর মধ্যে চন্দ্রগঞ্জে ডুকলেই দেখা যায় এমপি, মন্ত্রী এবং জেলা নেতাদের ছবিসহ রাস্তার পাশে এবং মোড়ে মোড়ে শত শত ডিজিটাল ব্যানার ও পেষ্টুন। বৈদ্যুতিক পিলার এবং বিভিন্ন কোম্পানীর বিলবোর্ড দখল করে তার ব্যানার, পেষ্টুন সাঁটিয়ে রাখা হয়েছে। পেষ্টুনের কারণে বৈদ্যুতির অনেক পিলার ঝুঁকিপুর্ণ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। পুরো বাজার এবং এলাকায় তার ব্যানার, পেষ্টুন ছাড়া অন্য কারো ব্যানার, পেষ্টুন তেমন একটা চোখে পড়েনা। ডিজিটাল ব্যানার, পেষ্টুন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা অন্তত অর্ধলক্ষ টাকা বকেয়া পাওনা আছে কাজী বাবলু ও তার লোকজনের কাছে।
ব্যবসায় দলীয় শক্তি প্রয়োগ :
চন্দ্রগঞ্জ বাজারে পুরনো সব জেনারেটর ব্যবসায়ীকে গুটিয়ে দিয়ে পুরো বাজারে তার জেনারেটর সংযোগ নিতে বাধ্য করা হয়েছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের। এতে জেনারেটর সার্ভিসের পুরনো ব্যবসায়ী নাছির খান জিল্লাল ও হারুন ষ্টোরের প্রয়াত হারুন চরম ভুক্তভোগি। তাদেরকে জোরপূর্বক জেনারেটর ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে, কেউ নতুন ভবন নির্মাণ করলে তার মালিকানাধিন কাজী ট্রেডার্স নামীয় দরজা গ্যালারী থেকে দরজাসহ যাবতীয় মালামাল কিনতে বাধ্য করা হতো। একইভাবে বাজারের অন্যান্য গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ীকে সিলিন্ডার বিক্রিতে বাধা দিয়ে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে এককভাবে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করা হতো। কেউ নিতে না চাইলে তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হতো।
এছাড়াও চন্দ্রগঞ্জ বাজারের দোকানঘর ও চন্দ্রগঞ্জ এলাকায় জমিজমা বিক্রি করতে হলেও তাকে চাঁদা দেওয়া বাধ্যতামূলক বলে জানিয়েছে স্থানীয় ভুক্তভোগীরা।
অভিযোগ ও ক্ষোভ :
স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, কুমিল্লায় র্যাবের হাতে ডাকাতি প্রস্তুতি ও অস্ত্র মামলায় জামিনে এসে টাকার বিনিময়ে ও নানা কৌশলে ছাত্রলীগের পদ ভাগিয়ে নিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বাবলু। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মী ছিল আওয়ামীলীগের শত শত নেতাকর্মীরা। তার বাহিনীর হয়ে কাজ না করায় প্রবাসী রুবেল, নুর হোসেন রাজু, ছাত্রলীগ নেতা রিয়াজ হোসেন জয়, আজিম পাটোয়ারী, মো. নোমানসহ অনেক নেতা-কর্মীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখমসহ বিভিন্ন মামলায় আসামি করে জেল খাটিয়েছেন এই বাবলু। দলের এসব নিবেদিত নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন চন্দ্রগঞ্জ বাজারে প্রকাশ্যে অবস্থান করতে পারেননি।
স্থানীয়রা জানায়, একসময় কাজী বাবলুর পরিবারে নুন আনতে পান্তা পুরাতো। তার বাবা সিরাজ কাজী হালচাষের পাশাপাশি বাজারের দিন গ্রামের ফুটপাতে বসে নারিকেল-সুপারি ক্রয়-বিক্রয় করতো। অথচ বর্তমানে ছাত্রলীগের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে মাদক, ডাকাতিসহ সন্ত্রাসী চাঁদাবাজি দখলবাজি করে বাবলু এখন অঢেল টাকা কড়ির মালিক। তার ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি এতদিন।
তবে একটি সূত্র জানায়, কাজী বাবলুর উত্থান এবং তার সকল অপকর্মের প্রধান উপদেষ্টা তার মেজো ভাই মাস্টার কাজী মোস্তফা কাজল। কাজল মাষ্টার তার শালিস বাণিজ্যসহ অবৈধ আয়ের ভাগ পেতে কাজী বাবলুকে দিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করাতো। এমনও শোনা গেছে কাজল মাষ্টার একজন শিক্ষক হয়েও প্রতিবছর হযরত দেওয়ানশাহ মেলায় জুয়া খেলায় জুয়াড়িদের সাথে শেয়ার দিতেন!
চন্দ্রগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, চন্দ্রগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রিয়াজ হোসেন জয়ের উপর হামলা চালায় কাজী বাবলু ও তার লোকজন। হামলার ঘটনায় চন্দ্রগঞ্জ থানায় মামলা করায় রিয়াজের বাড়িঘর ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। চন্দ্রগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে অছাত্র ও বয়স্কদের দায়িত্ব না দেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করায় এরআগেও রিয়াজের উপর একাধিকবার হামলা করা হয়েছে। সবশেষ এম. সজীবের উপর হামলা করে তাকে হত্যা করা কাজী বাবলুর পূর্বপরিকল্পনা ছিল। আমি মেধাবী ছাত্রনেতা এম. সজীব হত্যার বিচার চাই।
চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন লিঠন বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে দলের নেতা-কর্মীদের জিম্মী করে কাজী বাবলু চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে কোটি কোটি টাকা মালিক হয়েছেন। পক্ষান্তরে, দলের কর্মীরা হয়েছে তার হাতে নির্যাতন ও হামলা-মামলার শিকার। এমন কোনো কাজ নেই যেটা সে পারেনা। নিজের স্বার্থের জন্য কাজী বাবলু দলের কর্মীর উপর হামলা ও মামলায় আসামি করা এবং হত্যা করাও ছিল তার জন্য মামুলি ঘটনা।
চলবে…