জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চার দফা সুপারিশে বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করার এবং বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণের ওপর জোরালোভাবে আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে দিল্লির প্রগতি ময়দানের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার ‘ভারত মান্দাপাতামে’ জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি শীর্ষ সম্মেলনে ‘ওয়ান আর্থ’ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় তার সুপারিশের প্রথম পয়েন্টে বলেছেন, ‘এখানে জি-২০ এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং বাংলাদেশ সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সুপারিশ তৈরি করতে তাদের প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।’
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় পয়েন্টে বলেন, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে এবং সারা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী সাহসী, দৃঢ় এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিত।’
আরও পড়ুন- উলিপুরে গাঁজাসহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার
তৃতীয়ত, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের ত্রয়ীকার সদস্য হিসেবে তিনি বলেন, ‘জলবায়ুজনিত অভিবাসন মোকাবেলায় অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চালু করার জন্য আমি সকলকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসন্ন কপ-২৮ এ, আমি সকলকে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার সাথে ক্ষতি এবং ক্ষতির জন্য তহবিল বাস্তবায়নের উপর জোর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবশেষে অভিমত ব্যক্ত করেন, সব মানুষেরই উপযুক্ত জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকা উচিত।‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের তাদের ডিনজ দেশে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক সম্প্রদায় ভুলবেন না এবং তাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।’
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের পৃথিবীকে বাঁচাতে ও শক্তিশালীকরণে জি-২০ অংশীদারদের সাথে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি’।
তিনি বলেন, ‘আমাদের একে অপরের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং আমাদের মাতৃ পৃথিবীর যতœ নেওয়ার জন্য নিজেদেরকে পুনরায় প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।’
আরও পড়ুন- আন্দোলন ভিন্ন খাতে নিতে ইউনূস ইস্যু আনা হয়েছে: ফখরুল
২০২২ সালে গঠিত জাতিসংঘ মহাসচিবের গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শেখ হাসিনা উল্লিখিত সুপারিশগুলো করেছেন।
শীর্ষ সম্মেলনের এই অধিবেশনে ভাষণকালে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এমন একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা চাই যা দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্র্রভাব প্রশমন, সংঘাত প্রতিরোধ এবং জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য প্রযুক্তিগত স্থনান্তরকে অর্থায়নের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।’
অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে এই শীর্ষ সম্মেলনটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন ‘আমাদের মাতৃ পৃথিবী’ জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক সংকট, কভিড-১৯ মহামারী এবং নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চ্যালেঞ্জ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই চ্যালেঞ্জগুলো মানবজাতির শান্তি ও উন্নয়ন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি অন্য সম্প্রদায়ের গ্রহণ করা অপরিহার্য।’
তিনি আরও বলেন, বাস্তবতা হল মানুষ এবং আমাদের মাতৃভূমি কেবল পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমেই টিকে থাকতে পারে।
‘অতএব, আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা সবুজ এবং টেকসই উন্নয়নের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে’-উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন, আমরা সার্কুলার অর্থনীতির পদ্ধতিও নিচ্ছি।’
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে নগণ্য অবদান রাখলেও এর পরিণতির শিকার হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন- আধা কিলোমিটার সড়কে চরের মানুষের চরম ভোগান্তি
বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডসওয়েল রিপোর্ট ২০২১ অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে ১৩.৩ মিলিয়ন মানুষকে তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
শেখ হাসিনা বলেন, যদিও বাংলাদেশের প্রশমনের সুযোগ কম। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন এবং এসডিজি অর্জনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক প্রভাব মোকাবেলায় অনেক রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে তিনি গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ বা আশ্রয় নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, এই উদ্যোগের অধীনে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত তাঁর সরকার প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বিনা মূল্যে বাড়ি ও জমি দিয়ে পুনর্বাসন করেছে।
তিনি বলেন ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে গৃহহীন ও ভূমিহীন মুক্ত করা।’
বাংলাদেশ ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জলবায়ু অভিযোজনে শক্তিশালী অবস্থা অর্জন করেছে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করল মিয়ানমার
দুর্যোগ মেকাবেলার জন্য তাঁর সরকার ৪ হাজার ৫৩০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এছাড়া এখন বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য ‘মুজিব কিল্লা’ নামে আরও ৫৫০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করছে।
তিনি বলেন,‘বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য আমরা ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ চালু করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য ও সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ প্রণয়ন করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘২০২২ সালে আমার সরকার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা চালু করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। আমরা এই বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে সক্রিয় সমর্থনের আহ্বান জানাই।’