আসন্ন ঈদকে সামনে নিয়ে তাঁত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংকার শেষ নেই। কেমন হবে ঈদের বাজার। শাড়ি-লুঙ্গী বিক্রি হবে কি না এ নিয়ে তাদের মধ্যে চলছে নানা কল্পনা-জল্পনা।
উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় সে অনুযায়ী শাড়ির মুল্য না থাকায় উল্লাপাড়ার তাঁত ব্যবসায়ীদের দুর্দিন চলছে। তাদের উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি করতে না পাড়ায় অনেক তাঁত ব্যবসায়ী তাঁত বন্ধ করে দেওয়ায় প্রায় ৮২ হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে । তাঁতের শাড়ি বিক্রি করে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছে না তাঁত মালিকেরা।
শাড়ির উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় মুল্য কম হওয়ায় উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের। উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল রং, সুতা ও তাঁত সামগ্রীর মূল্য দুই থেকে চার গুন বৃদ্ধি পাওয়ায় শাড়ির উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। সে অনুযায়ী বাজারে বিক্রি করতে পারছে না তাঁত মালিকেরা।
আরও পড়ুন- রোকাইয়াকে বাঁচাতে প্রয়োজন ৪ লাখ টাকা
অপর দিকে পাওয়ার লুমে শাড়ি ও অন্যান্য কাপড় উৎপাদন হওয়ায় তাঁতের শাড়ির চাহিদাও কমে গেছে।
উল্লাপাড়ার তাঁত বোর্ড অফিস সুত্রে জানা যায়, উপজেলার বালশাবাড়ি, দাদরপুর, বাবলাপাড়া, গাড়লগাঁতী, নেয়ারগাছা, ইসলামপুর, পাইকপাড়া ও পাচিলা গ্রামে তাদের তালিকা ভুক্ত প্রায় ৫ হাজার পরিবার তাঁত ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। আর ওই ব্যবসায়ীদের প্রায় ১৬ হাজার ৪ শত ২০ টি তাঁত রয়েছে। ওই তাঁতের সাথে ৪৯ হাজার ২শত ৬০ জন শ্রমিক এর জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
এ এলাকার তাঁত ব্যবসায়ীদের মধ্যে ২শত ১৮ জনকে ২ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে।
অপর দিকে উপজেলার দূর্গানগর ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ড তাঁত সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল কাদের জানায়, তাদের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১১ হাজার পরিবার তাঁত ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। ওই ব্যবসায়ীদের প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার তাঁত রয়েছে। ওই ১ লাখ ২২ হাজার তাঁতকে ঘিরে প্রায় ২ লাখ
তাঁত শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করতো।
আরও পড়ুন- গোবিন্দগঞ্জে তেলবাহী লরি নদীতে; নিহত ১ পথচারী
করোনার প্রথম ধাপে লকডাউনে কাপড়ের দর না থাকায় লোকসান দিয়ে বিক্রি করায় তারা সয়সম্বল হারিয়ে বসে পড়ে। ফলে তাঁত ব্যবসায়ীরা প্রায় ৪৫ হাজার তাঁত বন্ধ করে দেয়। এতে ৮২ হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।
পুনরায় তাঁত ব্যবসায়ীরা তাঁত বোর্ড থেকে ঋণ করে ১৮ হাজার তাঁত চালু করে ঘুড়ে দাঁড়াতে চাইলে করোনার দ্বিতীয় ধাপ তাদের সেই আশা লন্ডভন্ড করে দেয়।
করোনার মহামারী শেষ হলেও রং-সুতার মহামারী ছাড়েনি, বরং রং ও সুতার দাম আরও ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শাড়ি কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু বিক্রয় মুল্য বাড়েনি।
বর্তমানে হাট- বাজারে শাড়ি কাপড় বিক্রি করতে গিয়ে লোকসান দিয়ে কাপড় বিক্রয় করতে হচ্ছে। এ লোকসান থেকে বাঁচার জন্য তাঁত ব্যবসায়ীরা প্রায় অর্ধেক তাঁত বন্ধ করে দিয়েছে। এতে প্রায় ৮২ হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেউ আবার জীবন-জীবিকার তাগিদে ঢাকা-গাজিপুরের বিভিন্ন গার্মেন্টসে চাকরি করছে।
তাঁত শ্রমিক বেল্লাল হোসেন, ঠান্ডু মিয়া ও মোঃ মোতাহার আলী জানায়, করোনার মহামারির পর তাঁত মালিকেরা কাপড় বিক্রি করতে না পারায় তাঁত বন্ধ করে দিয়েছে। এতে কয়েক হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। দু’এক জন মালিক তাঁত চালু রাখলেও কাপড়ের দাম না থাকায় মজুরি কমিয়ে দিয়েছে। এতে হাজার হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে এবং তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে।
আরও পড়ুন- দর বৃদ্ধির কারণ জানে না রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স
উপজেলার দূর্গানগর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের তাঁত মালিক মোঃ ওজেদ আলী জানায়, কিছু অসৎ রং ও সুতা ব্যবসায়ী রং ও সুতার দাম ৪০% বাড়িয়ে বিক্রি করছে। রং- সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজের ২০ টি তাঁত বন্ধ করে দিয়েছি।
অপর তাঁত ব্যবসায়ী সৈকোত হোসেন জানান, বাজারে রং-সুতার মুল্য বেশি কিন্তু কাপড়ের দাম কম হওয়ায় তাঁতের শাড়ির ব্যবসায়ীরা লোকশানে পড়েছে। এক পিস হাইব্রীট শাড়ী বোনাতে ২৫০ টাকা খরচ হয়। বাজারে তা বর্তমানে ২০০ টাকায় বিক্রয় করতে হচ্ছে। প্রতি পিস শাড়িতে ৫০ টাকা করে লোকশান হচ্ছে। তাই তাঁত বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
উল্লাপাড়া উপজেলার দূর্গানগর ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ড তাঁত সমিতির সভাপতি ও দূর্গানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল কাদের ব্যাপারি জানায়, করোনার আগে এক তোলা রং এর মূল্য ছিলো ১৫ টাকা। বর্তমানে সেই এক তোলা রং এর মূল্য ৭০ টাকা। এক বান্ডিল সুতার মূল্য ছিলো ১৬০০ টাকা। বর্তমানে সেই এক বান্ডিল সুতার মূল্য ৩৫০০ টাকা। বর্তমানে রং সুতার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এক পিস শাড়ি কাপড় উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৬০০ টাকা। হাট-বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে হয় ৫০০ টাকায়।
আরও পড়ুন- বিএনপি নেতা চাঁদ গ্রেপ্তার হয়েছে কি না জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট
এ ছাড়াও পাওয়ার লুমে শাড়ি ও অন্যান্য কাপড় উৎপাদন হওয়ায় তাঁত শাড়ির চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তাঁত মালিকরা কতো লোকশান দেবে? তাঁত মালিক ও শ্রমিকদের এখন দূর্দিন যাচ্ছে, দেখার বা শোনার কেও নেই ?
এ ব্যাপারে উল্লাপাড়া তাঁত বোর্ডের লিয়াজো কর্মকর্তা মোঃ সারোয়ার হোসেন জানান, উপজেলার তালিকাভুক্ত ৫ হাজার তাঁতি পরিবারের ১৬ হাজার ৪ শত ২০ টি তাঁত রয়েছে। এলাকার তাঁত ব্যবসায়ীদের মধ্যে ২শত ১৮ জনকে ২ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে।