উপকূলীয় অঞ্চলের দুধ উৎপাদনকারী খামারি ও কৃষকের ভাগ্যোন্নয়ন, কর্মসংস্থান, দুধ ও মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে ১৯৯৮ সালে চালু হয় মিল্ক ভিটার কার্যক্রম। উপজেলার মিতালীবাজার এলাকায় ৫ দশমিক ৪৭ একর জমিতে সরকারি এ সংস্থাটি স্থাপন করে দুগ্ধ শীতলীকরণ (ঠাণ্ডা) ও সরবরাহ কেন্দ্র। শুরুর দিকে ভালোই চলছিল সবকিছু। ৩৮টি প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদকারী সমবায় ইউনিয়নের আওতায় পাঁচ শতাধিক খামারি সেখানে দুধ সরবরাহ করতেন। তবে একসময় জেঁকে বসে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। ফলে দরিদ্রদের ভাগ্য বদলাতে এসে মিল্ক ভিটা আজ নিজেই ডুবতে বসেছে। স্বাবলম্বী হতে গিয়ে চরাঞ্চলবাসীও এখন ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ।
রায়পুর মিল্ক ভিটার আওতাধীন দেনায়েতপুর প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের সভাপতি দিলীপ চন্দ্র ঘোষ। ২০০৫ সাল থেকে তিনি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত। এ খামারির তিনটি খামারে গরু-মহিষ থেকে প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হতো কয়েকশ লিটার। এতে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি চরাঞ্চলের অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থানও হয়। কিন্তু মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি রায়পুর শীতলীকরণ কেন্দ্র দুধ সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এতে বিপাকে পড়েন দিলীপ কেন্দ্র। মিল্ক ভিটা থেকে নেয়া ঋণের বোঝা টানা ও গো-খাবার সংকটসহ নানা প্রতিকূলতায় লোকসানে পড়ে তাকে কম দামেই বিক্রি করে দিতে হয় গরু-মহিষ। শুধু দিলীপ চন্দ্র ঘোষই নন, রায়পুর উপজেলার পাঁচ শতাধিক খামারি পথে বসেছেন মিল্ক ভিটাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে।
স্থানীয়রা জানান, প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে দুধ কিনত মিল্ক ভিটা। এক একটি সমবায় সমিতি প্রতিদিন ৪০০-৫০০ লিটার দুধ সরবরাহ করত। এতে গড়ে প্রায় তিন হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করতেন সংশ্লিষ্টরা। পরে সেগুলো পাঁচ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক শীতলীকরণ মেশিনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ শেষে ঢাকার মিরপুরে মিল্ক ভিটার মূল কেন্দ্র পাঠানো হতো। খামার পরিচালনার জন্য ২০-৭০ হাজার টাকারও অধিক ঋণের পাশাপাশি গবাদিপশুর চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ দেয়া হতো সমবায় সমিতির সঙ্গে যুক্ত খামারিদের। কম দামে দুধ সংগ্রহ করে মিল্ক ভিটা লাভের মুখ দেখলেও, খামারিরা প্রায় সবাই উৎপাদিত দুধ বিক্রি ও ঋণ পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েন। তাই বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিদের ভাগ্যোন্নয়নের আশ্বাস দেন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে সমবায় খামারিদের জন্য আনা সোয়া ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ের উন্নত জাতের মহিষ প্রকল্পেও চরম অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা। এতে ভেস্তে যেতে বসেছে রায়পুর মিল্ক ভিটার দুগ্ধ কেন্দ্রের মাধ্যমে চরাঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বৃহত্তর পরিকল্পনা। দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ খামারিদের ভাগ্যোন্নয়নে গৃহীত এ প্রকল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এতে স্থানীয় পাঁচ শতাধিক সমবায়ী খামারিদের দেয়া আশ্বাস আশ্বাসই রয়ে গেছে। এসব কারণে খামারিদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
দুধ সংগ্রহ বন্ধ থাকায় একদিকে খামারিদের কাছ থেকে বকেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ এবং অন্যদিকে খামারিরা মিল্ক ভিটায় জমাকৃত শেয়ার-সঞ্চয় ফেরত চেয়ে দিয়েছেন পাল্টাপাল্টি আইনি নোটিস। দিলীপ কেন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘মিল্ক ভিটা কার্যক্রম বন্ধ করার পর ঋণের কিস্তি নগদ টাকা নেয়া শুরু করে। গত ২০১৯ সালে হঠাৎ সমবায়ী সমিতিগুলোকে ঋণের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের জন্য আইনি নোটিস দেয় মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ। অথচ তাদের কাছে সমবায়ী খামারিদের শেয়ার ও সঞ্চয়ের যে পরিমাণ আমানত জমা রয়েছে, তা বকেয়া ঋণের থেকেও বেশি। তাই আমরা নিজ নিজ সমিতির পক্ষ থেকে টাকা ফেরত চেয়ে মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষের কাছে আইনি নোটিস পাঠাই।
রায়পুর মিল্ক ভিটার এক কর্মকর্তা বলেন, ৩৮টি সমবায় সমিতি মিল্ক ভিটা থেকে ঋণ নিয়ে খামার পরিচালনা করত। মিল্ক ভিটায় দুধ দেয়ার মাধ্যমে কিস্তিতে ঋণের টাকা পরিশোধ করত তারা। দুধ সংগ্রহ বন্ধ হওয়ার পর থেকে লোকসানে পড়ে খামারিরা নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি। এতে খামারিদের কাছে ৬০ লাখ টাকা বকেয়া ঋণ পড়ে রয়েছে। এজন্য মিল্ক ভিটা আইনি নোটিশ দেয়।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায়, সে সময় কারখানা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. ফরহাদ হোসেন। অভিযোগ রয়েছে সমবায় খামারিদের কাছ থেকে কেনা দুধের গুণগত মান নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হতো। এতে খামারিরাও মিল্ক ভিটায় দুধ দেয়া নিয়ে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। কাজিরচর ও চর কোরালিয়ার কয়েকজন খামারি জানান, মিল্ক ভিটা দুধের মূল্যবাজার থেকে কম দিলেও তারা প্রজনন বীজ, চিকিৎসাসেবা, ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে খামারিদের সহযোগিতা করত; যা চরাঞ্চলের খামারিদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই ছিল। যদিও চিকিৎসাসেবা, ওষুধসহ নানা প্রণোদনা ছাড়ে সংশ্লিষ্টদের অনিয়মের শেষ নেই। কাজির চর দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি মফিজ মিয়া বলেন, ‘মিল্ক ভিটা বড় বড় রাঘববোয়ালরা নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে অনিয়মের প্রতিবাদ করে কিছুই করতে পারব না। তাই দুধ সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়ার পর খামারিরা দিশেহারা হয়ে কম দামেই তাদের গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুধ ও মাংসের পাশাপাশি খামারিদের ভাগ্যোন্নয়নের সেই বিশেষ প্রকল্পটি রায়পুর মহিষ উন্নয়ন ও কৃক্রিম প্রজনন প্রকল্প নামে অনুমোদন পায়। সরকারি ৭৫ ভাগ ও মিল্ক ভিটা সমবায়ীদের ২৫ ভাগ অর্থায়নে ১৮ কোটি ২৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকার এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের থেকে উন্নত মুররাহ্ জাতের মহিষ কেনে কর্তৃপক্ষ। সেগুলো স্থানীয় ক্ষুদ্র সমবায়ী খামারিদের মাঝে ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ ও ষাঁড়-মহিষ থেকে সংগৃহীত বীজ (সিমেন) খামারিদের দেশীয় মহিষে সরবরাহের কথা ছিল, কিন্তু সেগুলো বণ্টন না করে মিল্ক ভিটাই লালনপালন শুরু করেছে। মহিষের সে প্রকল্প থেকে দৈনিক ২০০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। খামারিদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টরা নিজেদের লাভের জন্য এসব দুধ বেশি দামে বাইরে বিক্রি করে দেয়, যার জন্য দুধ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। এতে সমবায়ী খামারিদের খেসারত দিতে হচ্ছে।
রায়পুর মিল্ক ভিটার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ডা. আশরাফুজ্জামান অবশ্য বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক। পাঁচ বছর আগে ১০০টি মহিষ আনা হয়েছিল। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৬৩টি। এছাড়া ৮০টি মহিষ বিক্রিও করা হয়েছে। এতে দেড় কোটি টাকা মিল্ক ভিটার আয় হয়েছে। রাখালের মাধ্যমে উন্নত জাতের মহিষগুলো দেখভাল করা হচ্ছে।’
দুধ সংগ্রহ বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা প্রয়োজন। তবে রায়পুর সমিতির খামারিরা মিল্ক ভিটায় দুধ দিতে চাইলে আমরা সংগ্রহ করব। কিন্তু তারা শুধুই মিথ্যাচার করছে, বেশি দাম পাওয়ায় বাজারেই তা বিক্রি করে দেয়।’