মা ইলিশের বাধাহীন প্রজননের জন্য সকল প্রকার মৎস্য আহরণে ১১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠতে বাকি আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। আজ বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) রাত ১২টার পর থেকেই দেশের সকল নদ-নদী ও সাগরে আবার শুরু হবে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরার মহোৎসব। সেই লক্ষ্যে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মৎস্য আড়ত ও জেলেপল্লীতে চলছে জোর প্রস্তুতি। জেলেরা দীর্ঘদিন অবসর সময় কাটিয়ে সাগরে ও মেঘনা নদীতে যাওয়ার উদ্দেশে তাদের নিজ নিজ মহাজনের আড়ত ও ট্রলার মালিকের গদিতে ফিরেছেন।
তবে এবারের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা (অবরোধ) নিয়ে মৎস্য সংশ্লিষ্টরা দিলেন ভিন্ন তথ্য। তাদের দাবি, এবার অবরোধের সময় নির্ধারণ সঠিক হয়নি। মা ইলিশ ডিম ছাড়ে পূর্ণিমা গোনে (সময়কাল)। কিন্তু এবার অবরোধ দেয়া হয় অমাবস্যার গোনে (সময়কাল)। মেঘনায় এবার পৃথক ৬ বারের ভ্রাম্যমান আদালতে বরিশালের হিজলা গ্রামের ৫ জেলেকে কারাদন্ড দেয়া হয়, জাল পোড়ানো হয়, তিনটি নৌকা আটক ও ইলিশ জব্দ করা হয়।
আরও পড়ুন— মিরপুরে শ্রমিক-পুলিশ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, পরিস্থিতি থমথমে
তারা আরও জানান, ইলিশের প্রজননের জন্য অবরোধ দেওয়া হলেও অর্ধেক মা ইলিশও ডিম ছাড়তে পারেনি। অবরোধের পরেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই অবরোধ ১১ অক্টোবরের পরিবর্তে আরো ১৫ দিন পিছিয়ে পূর্ণিমার গোনে দেওয়া উচিত ছিল বলে তারা মনে করেন।
বুধবার (১ নভেম্বর) বিকেলে রায়পুরের আলতাফ মাষ্টার ঘাট, হাজিমারা, সাজু মোল্লার ঘাটসহ ৮টি মাছ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য ট্রলার ও বোড এসে ভিড়েছে ঘাটগুলোতে। জেটিতে জাল, তেলের ড্রামসহ বিভিন্ন মালামালের স্তূপ। জেলেরা সেগুলো তুলছেন ট্রলারে। আবার কেউ কেউ ঝুড়িতে করে বরফ নিয়ে ভরছেন ট্রলারের কুঠুরিতে। মহাজন, আড়তদার ও ট্রলরা মালিকরা নিজ নিজ গদিতে হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত। এ সময় জেলে-মহাজন ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নানা ক্ষোভ ও হতাশার কথা।
আরও পড়ুন— ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিজিবি মোতায়েন
জেলে মাহমুদ আলি, সাবু মাজি, সোলায়মান, হুমায়ুন গাজি ও আব্দুল হাওলাদারসহ অনেকেই জানান, তারা অবরোধেই শেষ হয়ে গেছে। ছয় মাসের ইলিশ মৌসুমের তিন মাসই থাকে অবরোধ। তার ওপর দফায় দফায় দুর্যোগে সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। প্রত্যেকে জেলে হাজার হাজার টাকা দেনাগ্রস্ত হয়ে পেড়েছেন। অবরোধকালীন সরকার তাদের যে খাদ্য সহায়তা দেয় তা খুবই সামান্য। তারা সহায়তা বৃদ্ধির দাবি জানান সরকারের কাছে।
কয়েকজন ট্রলারের মাঝি জানান, অবরোধের সময় ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে দেশীয় জেলে-মহাজনরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হচ্ছে ভিনদেশি জেলে-মহাজনরা। সরকার যদি শুধু ২২ দিনের অবরোধ (নিষেধাজ্ঞা) রেখে ৬৫ দিনের অবরোধ তুলে নেয় তাহলে তারা উপকৃত হতেন।
চান্দারখালের মৎস্য আড়তদার আরিফ হোসেন ও কাদের বেপারির দাবি, মা ইলিশ মূলত পূর্ণিমার গোনে ডিম ছাড়ে। কিন্তু এবারের ২২ দিনের অবরোধ (নিষেধাজ্ঞা) দেওয়া হয়েছে অমাবস্যার গোনে। পূর্ণিমার সময় ডিম ছাড়ার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ সাগর থেকে শাখা নদ-নদীতে উঠে আসে। এবারের অবরোধ সফল হয়েছে বলে মনে করছেন না তারা। বিশেষজ্ঞরা কী ভেবে অমাবস্যার গোনে অবরোধ দিলেন, তাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
আরও পড়ুন— বঙ্গবন্ধুকে দেয়া ডক্টর অব ল’জ ডিগ্রি নিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা
এই মৎস্য আড়তদাররা হতাশা প্রকাশ করে আরো জানান, তারা একেকজন ট্রলার মালিক ও আড়তদার এই মৌসুমে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ বছর ইলিশ কম ধরা পড়ায় তারা প্রত্যেকেই লোকসানে আছেন। তাদের এই লোকসানে পড়ার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, ভরা মৌসুমে যখন বেশি ইলিশ ধরা পড়ে এবং দামও ভালো পাওয়া যায়, ঠিক তখনই ৬৫ দিনের অবরোধ দেওয়া হয়। ওই সময় ভারতের জেলেরা এসে সমস্ত মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে দেশীয় জেলে-মহাজনরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ৬৫ দিনের অবরোধ না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
রায়পুরের সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার মালিক লোকমান বেপারি জানান, তাদের সমিতির আওতায় ৫৫টি ট্রলার রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলার চারটি ডকে দেড় শতাধিক ট্রলার মেরামত করে সাগরে যাওয়ার জন্য প্রস্তু রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকেই এসব ট্রলার সাগরের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
আরও পড়ুন— আল-আকসা মসজিদ বন্ধ করে দিল ইসরায়েল
রায়পুর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারও রায়পুরের জেলে-মহাজনরা যথাযথভাবে নিষেধাজ্ঞা পালন করেছেন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সরকার নিষেধাজ্ঞার সময়ে নির্ধারণ করেছে। সেভাবেই নিষেধাজ্ঞা সফলে আমরা কাজ করেছি।’