জাতীয় সংসদে সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩ পাস হয়েছে। এই আইন ২০১৮ সালে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে প্রতিস্থাপন করবে।
বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদের আজকের কার্যধারা অনুযায়ী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে উত্থাপন করলে তা পরে কণ্ঠ ভোটে এ বিলটি পাস হয়।
এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ‘বিতর্কিত’ সাইবার নিরাপত্তা বিল জাতীয় সংসদে পেশ করেছিলেন।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যে সুবিধা হয়েছে একই সঙ্গে সাইবার স্পেসে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ২০১২ সালে রামুতে বিএনপি-জামায়াত শিবিরের সদস্যরা একটা মিথ্যা তথ্য ফেসবুকে-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে কীভাবে অনেক সম্পদ ও প্রাণের ক্ষতি করে। ২০১৬ সালে কেন্দ্রিয় ব্যাংকে সাইবার হামলা চালিয়ে হ্যাকাররা ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে যায়। এরপর আমরা কম্পিউটার রেসপন্স টিম তৈরি করি।’
আরও পড়ুন- বাতিল নয়, সংশোধন হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মাসেতু নির্মাণের শেষ দিকে সামাজিক মাধ্যমে একটা গুজব ছড়ানো হলো সেতুর পিলার শক্ত করতে নাকি শিশুদের মাথা দরকার। তারই ফলশ্রুতিতে মিরপুরে রেনু নামে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ধরনের অপরাধ বন্ধে বিলটি প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যেগুলো জামিন অযোগ্য ধারা ছিল তা জামিনযোগ্য করা হয়েছে।’
সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি অনুযায়ী, অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিলটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। স্থায়ী কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে তাদের প্রতিবেদন সংসদে জমা দেয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কার্যক্রম স্থগিত করে আনীত এই বিলে ৪টি জামিন অযোগ্য ধারা রাখা হয়েছে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর (রবিবার) সাইবার নিরাপত্ত বিলের চূড়ান্ত রিপোর্ট সংসদে পেশ করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
আরও পড়ুন- সমালোচনাকারীরাই এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিচ্ছে
ঐদিনই কমিটির পক্ষে সংসদীয় কমিটির সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক রিপোর্টটি উত্থাপন করেন। বিলটিতে ৩২ ধারা বাদ দেয়াসহ ৪২ ও ২১ ধারায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বিলটির ৩৪ ধারায় কিছু শব্দগত পরিবর্তন ও মিথ্যা মামলাজনিত শাস্তির বিধানাবলী আনা হয়েছে। এখানে কমিটি পরিস্কার করে বলেছে, (১) যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ দায়ের করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ না জানিয়েও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহলে সেটি হবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করেছেন উক্ত ব্যক্তি মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে সেই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
কোনো ব্যক্তি যদি উপধারা (১) এর অধীন এই আইনের একাধিক ধারায় কোনো মামলা বা অভিযোগ করেন, তাহলে উক্ত ধারায় বর্ণিত অপরাধের মধ্যে মূল অপরাধের জন্য যার দণ্ডের পরিমাণ বেশি হয় সেই দণ্ডের পরিমাণ হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে। (৩) কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল উপধারা (১) এর অধীন সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারবে।
আরও পড়ুন- সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ৩২ ধারা বাতিলসহ বেশ কিছু সংশোধনী এনে সুপারিশ চূড়ান্ত করে কমিটি। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে এই সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হলো।
গত ৫ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) সাইবার নিরাপত্তা বিল সংসদে উত্থাপন করা হয়। এরপর বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
এছাড়া বিলের ২১ ধারায় শব্দগত পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা আছে। এখানে ‘পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা’ এর স্থলে ‘পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হবে। বিলের ৩২ ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই ধারায় অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছিল।
ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টভুক্ত অপরাধ করলে তার সাজার বিধান করতে এটি যুক্ত করা হয়েছিল। বিলের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশী ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া আছে পুলিশকে। এখানে সংশোধনী এনে বলা হচ্ছে, এই ধারায় সাব ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তার জায়গায় পুলিশ পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তা বিনা পরোয়ানায় তল্লাশী ও গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
আরও পড়ুন- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে জবি ছাত্রী
উত্থাপিত বিলের ৮ ধারায়ও সংশোধনী আনা হচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যম থেকে তথ্য–উপাত্ত অপসারণ ও ব্লক করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এই ধারায়। এখানে আগে বলা ছিল যদি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘প্রতীয়মান’ হয় ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করবার জন্য, মহাপরিচালকের মাধ্যমে, বিটিআরসিকে অনুরোধ করিতে পারিবে। এখানে প্রতীয়মান শব্দের জায়গায় ‘তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ সাপেক্ষে, বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে’ প্রতিস্থাপন করা হবে।
সরকার গত ৭ আগস্ট জানায় তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘রূপান্তর’ এবং আধুনিকায়ন’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার নাম হবে সাইবার নিরাপত্তা আইন। যেখানে বিদ্যমান আইনের কিছু ধারা সংশোধন করা হবে। গত ২৮ আগস্ট মন্ত্রিসভা সিএসএর চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন করে।