দেখে মনে হচ্ছে যাত্রীরা রেলওয়ে ষ্টেশন বসে আছে ট্রেনের অপেক্ষায়। আসলে তারা এসেছে শরীয়তপুর জেলা সার্ভার ষ্টেশন, নির্বাচন অফিসে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ভুল সংশোধন, এলাকা পরিবর্তন ও অন্যান্য কাজে সেবা পেতে। এখানে সেবা প্রত্যাশীদের নানাভাবে হয়রানি করা সহ দুর্ব্যবহার ও ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সেবা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা জানান, দিনের পর দিন ঘুরলেও কাজ না করে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। আবার টাকা দিলে কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। না দিলে ঘুরতে হয় দিনের পর দিন; মাসের পর মাস।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, নির্বাচন অফিসে সেবা নিতে আসা চর পালং এলাকার জোছনা বেগম; দুপুর গড়িয়ে যাওয়ায় মা ও শিশু দু’জনেরই মুখ ক্ষুধায় শুকিয়ে গেছে! মায়ের কোলের শিশুটি কাঁন্না করছিল, তাই মা উপায়ন্তর না পেয়ে বোতলে পানি এনে খাওয়াচ্ছিল অবুঝ শিশুটিকে।
এমন দৃশ্য দেখে জিঙ্গাসা করতেই বলে উঠলেন, ‘ভোটার কার্ড সংশোধনে জন্য এসেছি। আজ প্রথম বার না। আরও কয়েক বার এখানে এসেছি, কাজ হয় নাই। আজও এসে সকাল থেকে বসে আছি। আমরা কোন টাকা-পয়সা দেই নাই, এই কারণে আমরা বসে আছি। যারা টাকা দিতে পারে তারা তাড়াতাড়ি কাজ করিয়ে চলে যায়।’
আরও পড়ুন- এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগঃ গ্রামপুলিশকে মারধর, জরিমানা, ভাতা বন্ধ করলেন চেয়ারম্যান
শুধু সেবা প্রার্থী জোছনা নয়। আরও অনেকেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে নির্বাচন অফিসে সেবা নিতে এসে। নির্বাচন অফিসের ভেতর ঢুকতে দেখা যায় অনেক নারী-পুরুষের ভীড়। অনেকেই বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেবা প্রত্যাশীদের বসার জন্য একটি বেঞ্চ ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে সিঁড়ি সহ মেঝেতে সেবা প্রার্থীদের বসে থাকতে দেখা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। নির্বাচন অফিসের সদর উপজেলা অফিসার বিকাশ চন্দ্র দে অফিস চলাকালীন সময় অফিসে কক্ষে নেই। সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে সেবা নিতে আসা অনেকেই দীর্ঘ সময় বসে রয়েছে অফিসারের রুমের সামনে।
অপেক্ষারত পাপিয়া ও নাছিমা সহ অনেকেই বলেন, সকাল থেকে বসে আছি। দুই ঘন্টার বেশী সময় ধরে। অফিসার তার কক্ষে নেই। এই অফিসের একটা স্টাফও কি অফিসারকে ফোন করে বলতে পারে না যে এখানে অনেক লোকজন বসে আছে, তাড়াতাড়ি আসেন।
নড়িয়া উপজেলার হামিদা বলেন, ‘আমি ভোটার কার্ড সংশোধনের জন্য আসছি। মোবাইলে ম্যাসেজ আসে না। তাই এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসলে আমাকে রাগান্বিত হয়ে বলে, কথা বললে বুঝেন না কেন।’ সেবা না পেয়ে কষ্ট নিয়ে ফিরে যান হামিদা।
আরও পড়ুন- বর্তমান প্রেক্ষাপটে তরুণদের দিক নির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী
জাজিরা উপজেলার নাম প্রকাশ না করে এক নারী বলেন, ‘আমার আইডি কার্ডে বয়স ভুল হয়েছে, বয়স বাড়াতে হবে। জাজিরা নির্বাচন অফিস থেকে শরীয়তপুর অফিসে যেতে বলে। এখানে আসলে আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা চায়।’
কে চায় জানতে চাইলে বলেন, ‘উপর তলায় স্যারের কাছে যে ফাইল জমা দেয় দাঁড়ি ওয়ালা একটা লোক (খায়ের) সে চায়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অফিসের দালাল এস.দাস জানান, সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে দিয়েও নতুন ভোটারদের কাছ থেকে আইডি কার্ড করতে অফিস ৫ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। ভোটার আইডি কার্ড পাওয়া নাগরিক অধিকার। এই টাকা নেয়াতে জুলুম মনে করছে নতুন ভোটাররা। টাকা না দিলে, নতুন ভোটারদের বয়স নিয়ে তালবাহানা করে।
২৯ ও ৩০ আগস্টে জেলা নির্বাচন অফিসে সদর উপজেলার অনেকেই নতুন ভোটার আইডি কার্ড করতে আবেদন করেছে। এর ভেতর দেখা যায়, অনেক নতুন ভোটার প্রার্থীর বয়স হয় নাই।
নির্বাচন অফিসের নিচতলায় নতুন ভোটার আইডি কার্ড সহ কিছু ক্যাটাগরি আইডি কার্ডের সংশোধের কাজ করা হয়। এই সার্ভার রুমে কর্মরত জুবায়ের, মুন্নি, ফারুক ও রানা।
নতুন ভোটার হতে ৫ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে এবং অপ্রাপ্তরা বিদেশগমনের জন্য টাকা দিয়ে ভোটার হচ্ছে এ ব্যাপারে সার্ভার রুমে কর্মরত জুবায়েরকে জিঙ্গাসা করলে তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘আমরা জন্ম নিবন্ধন নিয়ে ভোটার বানাচ্ছি। কেউ যদি জন্ম নিবন্ধনে বয়স বানিয়ে নিয়ে আসে তাহলে আমাদের কি করার আছে।’
আরও পড়ুন- কাস্টমসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব, মামলা
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, সার্ভার রুমে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ লিখা থাকলেও এখানে বহিরাগত লোকজন বসে আছে।
অফিসে আসা সেবা প্রার্থীরা জানান, এরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লালিত দালাল। এই দালালরা জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে টাকার বিনিময়ে কাজ করিয়ে নেন। এতে করে অন্যন্য সেবা প্রার্থীদের টাকা ছাড়া সেবা দিতে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। এছাড়াও সাড়া দেশের ন্যায় শরীয়তপুরেও ভুলে ভরা ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনে দালালের মাধ্যমে কর্মকতা-কর্মচারীরা হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ-লক্ষ টাকা।
বিষয়টি জেলা নির্বাচন অফিসার সোহেল সামাদকে জানালে তিনি নিচ তলায় নেমে এসে দেখেন অনেক লোকের ভীড়। সেই সাথে ফ্রন্ট ডেস্ক ও সার্ভার রুমে বসে আছে বহিরাগত লোক (দালাল)। সব কিছু দেখে জেলা নির্বাচন অফিসার বাহিরাগতদের বাহির করে দেন। সেই সাথে সেবা প্রার্থীদের বলেন, ‘যত সময় লাগুক আজকে সবার কাজ করে দেয়া হবে।’
এ বিষয়ে জেলা নির্বাচন অফিসার সোহেল সামাদ বলেন, ‘যারা অভিযোগ করেছে তাদের আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। আমি সমস্যার সমাধান করে দিব। নির্বাচন অফিসের এরকম ভোগান্তির অবসান চান জেলার সেবা প্রত্যাশীগণ।’