গোটা বিশ্ব যেখানে পশ্চিমা আধিপত্যের কাছে অনেকটাই অসহায়, তখন একাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধে ইউক্রেনকে পশ্চিমারা একতরফাভাবে যে পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা করছে, তার বিপরীতে রাশিয়াকে তার তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষী দেশগুলো বিন্দুপরিমাণও সহায়তা করছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত নীতি-নৈতিকতা ও অন্য দেশে শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করে আসছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০০৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রথমবারের মতো তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী আচরণের বিষয়টি তুলে ধরেন। তবে তখনও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে অংশীদার হিসেবেই বিবেচনা করতেন পুতিন। কাল পরিক্রমায় এখন তা শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
পুতিন তার সাম্প্রতিক বক্তব্যেও এটা পরিষ্কার করে বলেছেন, মার্কিন আধিপত্যকে প্রতিহত করতেই মূলত নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়া। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর অবস্থান কী? বিশেষ করে পুতিনের কথিত মিত্ররা আদৌ কি যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে চায়?
ইরান ব্যস্ত সমঝোতা নিয়ে
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। পুলিশি হেফাজতে মাহসা আমিনি নামে এক তরুণীর মৃত্যুর জেরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখে ইরান। দেশটির কট্টরপন্থি সরকার বর্তমানে পশ্চিমাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে ব্যস্ত। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ইরানের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, তা তুলে নিতে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাইসি ও বাইডেন প্রশাসন।
ইতমধ্যে সটকে পড়ছে চীন
যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনের কাছ থেকেও সাহায্য চেয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে শুরুতে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি যে সমর্থন ছিল, ধীরে ধীরে সেখান থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে চীন।
আরও পড়ুন- জন্মের পরই দেওয়া হবে এনআইডিঃ মন্ত্রিপরিষদ সচিব
মার্কিন ডলারের আধিপত্য রুখতে ও বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য পুতিনের প্রচেষ্টায় যোগদানের কোনো আগ্রহ নেই চীনের। যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি ইউক্রেনের ভূখণ্ড সংযুক্ত করার বিষয়ে পুতিনকে সমর্থন দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
বিপদে সাড়া নেই এরদোয়ানের
পশ্চিমাদের সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের ব্যক্তিগত সমস্যা রয়েছে। ২০১৬ সালে তুরস্কে অভ্যুত্থানচেষ্টার সঙ্গে পশ্চিমারা জড়িত বলে অভিযোগ এরদোয়ানের। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। তবে নিজ স্বার্থে ইউক্রেনকে বায়রাক্তার টিবি টুর মতো অত্যাধুনিক ড্রোন দিয়ে সহযোগিতা করেছে তুরস্ক।
রাশিয়ার ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে তুরস্ক। শুধু তাই নয়, পুতিনের ভাষণের মাত্র একদিন আগে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো রাশিয়ার এমআইআর পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে রাশিয়ার বেশিরভাগ ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করেছে পশ্চিমারা। বেলজিয়ামভিত্তিক সুইফট আন্তঃব্যাংক মেসেজিং সিস্টেমের বিকল্প হিসেবে পেমেন্ট সিস্টেম এমআইআর চালু করে রাশিয়া। আর সেটি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল তুরস্ক।
সবশেষ ইউক্রেনের ভূখণ্ডকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছে এরদোয়ান সরকার; বরং এটিকে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে তারা।
পিছপা ভারত
যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে তেল এবং অন্যান্য পণ্যের আমদানি বাড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করে ভারত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে মস্কোর লড়াইয়ে সমর্থন দেয়া থেকে সরে আসছে নয়াদিল্লি।
আরও পড়ুন- ৫ থেকে ১১ বছরের শিশুদের কোবিড ভ্যাকসিনের শুভ উদ্বোধন
পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার জেরে জ্বালানি তেল ক্রয়ে রাশিয়া রুবলে মূল্য পরিশোধের জন্য শর্ত দিলেও সম্প্রতি ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার এ শর্ত মানতে নারাজ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ১৬ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তানে সাংহাই কো-অপারেশন অরগানাইজেশনের শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
সরে যাচ্ছে আর্মেনিয়া
রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা মিত্র হিসেবে পরিচিত আর্মেনিয়াকেও হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন পুতিন। আজারবাইজানের সঙ্গে যুদ্ধের পর রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা-সিএটিও ইয়েরেভানকে সমর্থন দিতে অস্বীকার করার পর আর্মেনিয়ার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সম্পূর্ণভাবে জোটটি ত্যাগ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সমর্থন নেই মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর
কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ত তোকায়েভও নিজেকে পুতিনের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। অথচ চলতি বছরের জানুয়ারিতে অভ্যুত্থানচেষ্টার অভিযোগ এনে ব্যাপক বিক্ষোভ দমনে দেশটির সরকারকে সাহায্য করে রুশ বাহিনী।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধে স্বেচ্ছায় অংশ নিতে রাশিয়ার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান এবং কিরগিজস্তান। তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে অর্ডার অব মেরিটে ভূষিত করেছিলেন পুতিন। সেই তাজিকিস্তানও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার ঝুঁকিতে রুশ পেমেন্ট সিস্টেমে সায় দেয়নি।
আফ্রিকা-মধ্যপ্রাচ্যের সমালোচনা
মধ্যপ্রাচ্যের দুই বৃহত্তম জ্বালানি রফতানিকারক দেশ কাতার এবং কুয়েতও রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক করেছে। ইউক্রেনে শক্তি প্রয়োগের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দেশটির সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়েছে তারা।
আফ্রিকাতেও রাশিয়ার আগ্রাসনের সমালোচনা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-আদ্দো জাতিসংঘে রাশিয়ার সমালোচনা করেন।
একাই লড়ছেন পুতিন
কথিত মিত্র দেশগুলো পশ্চিমাদের দ্বিমুখী আচরণের বিষয়ে নীরব থাকলেও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন একাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। এটি তাকে আরও বিপজ্জনক ও আগ্রাসী করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যদিও অনেকের ধারণা, একা লড়াই করতে গিয়ে বিশ্ব থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারেন পুতিন।