বন্যায় লক্ষ্মীপুরের প্রায় সবকটি এলাকা এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে। রাস্তা-ঘাট, ফসলি মাঠ, বাড়ির উঠোন, রান্না ঘর সবখানে এখন পানি আর পানি। কোথাও বুক পরিমাণ পানি, কোথাও কোমর পর্যন্ত আবার কোথাও হাঁটুপানি। ঘরের ভেতরেও পানি। চারিদিকে থই থই করছে পানি। পানিতে তলিয়ে আছে নলকূপ, শৌচাগার।
প্রায় মসজিদ ও বিভিন্ন উপাসনালয়ের ভেতরেও পানি ঢুকে আছে। কোনো কোনো মসজিদে এখন আর নামাজ হয় না। শুধু আযান হয়। আবার কোনো মসজিদে ব্যবস্থা নেই ওযুর পানির। বাধ্য হয়ে বন্যার অপরিষ্কার পানি দিয়েই ওযু করতে হয়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দুর্গত গ্রামের বাসিন্দাদের। বন্যার পানির সঙ্গে শৌচাগার একাকার হয়ে আছে। সুপেয় পানির সংকট তো আছেই।
দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত রোগসহ নানা জটিল রোগের শঙ্কায় রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বৃদ্ধ এবং শিশুরা। এদিকে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবারের (২৭ আগস্টের) তুলনায় বুধবার (২৮ আগস্ট) পানি বেড়েছে অন্তত ১ ফুট। পাঁচ উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে আছে ১০ লাখ মানুষ।
চলমান বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে এত দিন যারা বাড়ি-ঘর ছাড়তে চাননি, তাদের অনেকেই এখন উঠছেন আশ্রয়কেন্দ্রে ও স্বজনদের বাড়িতে। বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকেই। তবে লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানিয়েছেন, প্রত্যেক মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জেলার পাঁচটি উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার প্রতিটি এলাকাই বিপর্যস্ত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে পানি। ১৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এসব মানুষের কেউ কেউ খাবার, ওষুধ, স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পানিবাহিত নানা রোগ।
কয়েকদিনে পৌর এলাকা ও সদর উপজেলার বন্যা কবলিত মান্দারী, দিঘলী, দত্তপাড়া, লাহারকান্দি, বাঙ্গাখাঁ, পার্বতীনগর, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জের মিয়ার বেড়ি এবং কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা, রামগতি উপজেলার চর বাদাম, চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে গিয়ে মানবিক বিপর্যয় লক্ষ্য করা গেছে।
দিঘলী এলাকার একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া নারী আমেনা বেগম বলেন, ঘরে পানি উঠায় আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছি। কেন্দ্রটি একতলা ভবন। এখন ভবনের ভেতরেও পানি ঢুকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হয়ত আশ্রয় কেন্দ্রেও থাকতে পারবো না। একই এলাকার বাসিন্দা মরন আলী বলেন, মান্দারী থেকে দিঘলী সড়কের মাঝ বরাবর অংশে পানির উচ্চতা অনেক বেশি।
বিশেষ করে ওয়াপদা খালপাড় সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বুক সমান পানি। খালের পশ্চিম এবং পূর্ব পাড়ের লোকজন পুরোপুরি আটকা পড়ে আছে। নৌকা না থাকায় সেসব এলাকায় কেউ যেতে পারছে না। ত্রাণও পৌঁছায় না।
দিঘলী ইউনিয়নের বাসিন্দা সবুজ মিয়া বলেন, সবচেয়ে বেশি পানি আমাদের এলাকাতে। গলা পরিমাণ পানি। স্থানীয় শানকিভাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এলাকার লোকজন চরম খাদ্য সংকটে আছে। অনেকের রান্না করার মতো ব্যবস্থা নেই।
মান্দারী ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল আজিজ বলেন, ইউনিয়নের সবগুলো ওয়ার্ডের অবস্থা শোচনীয়। সবার ঘরেই পানি। টিউবওয়েল পানির নিচে। শৌচাগার নেই। সুপেয় পানির চরম সংকট। যে দু-একটি টিউবওয়েল এখনও পুরোপুরি ডুবেনি, দূরদূরান্ত লোকজন সেখান থেকে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে।
কুশাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মোজাম্মেল হায়দার বলেন, মসজিদে ভেতরে পানি। তাই মুসুল্লিদের নামাজ পড়ার মতো অবস্থা নেই। মসজিদে শুধু আযান হয়। পরিস্থিতি দিন দিনই অবনতি হচ্ছে। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান বলেন, যে পরিমাণ পানির চাপ, সে হিসেবে পানি রেগুলেটর দিয়ে বের হতে পারছে না। বৃষ্টির কারণে পানির উচ্চতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।