১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ভারতীয় বেতার আকাশবাণী তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিল, ‘যিশু প্রয়াত। এখন কোটি কোটি মানুষ ক্রুশচিহ্ন পরে যিশুকে স্মরণ করে। সম্ভবত একদিন মুজিবকেও এমনিভাবে স্মরণ করা হবে।’
১৭ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমসের শিরোনাম ছিল– ‘মুজিবের মৃত্যুতে ভারত শোকাহত’। একই দিনে সানডে স্ট্যান্ডার্ডের শিরোনামে বলা হয়– ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিব সেনা অভ্যুত্থানে নিহত, খন্দকার নতুন প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটি চলছে সামরিক আইনে।’
ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম স্টেটসম্যান পত্রিকা তার মূল শিরোনামে লিখেছিল– ‘মুজিবের মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাংলাদেশ শোকাহত, ঘটনাপ্রবাহে নজর রাখছে ভারত’। পত্রিকাটি প্রায় অর্ধেক পৃষ্ঠাজুড়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডসহ তার জীবনী প্রকাশ করেছিল সেদিন। নিবন্ধটি একটি সুন্দর বাক্য দিয়ে শুরু করে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা ঘোষণার পেছনের প্রেরণা।’
আরও পড়ুন- আজ বেদনাবিধুর জাতীয় শোক দিবস
১৭ আগস্ট টাইমস অব ইন্ডিয়া ১৬টি আলাদা আলাদা সংবাদ প্রকাশ করে। এর মধ্যে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল– ‘বাংলা এখনও বিচ্ছিন্ন’। অন্য খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে’। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া সংবলিত খবরের শিরোনাম ছিল– ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে’। সোভিয়েত সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য ছাড়াই সামরিক অভ্যুত্থানের খবর প্রকাশ হয়েছে। ‘বিদেশি প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামের খবরে মিসর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়াও প্রকাশিত হয়।
অন্য প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য খন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। সেখানে এটাও উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তান ৫০০ টন চাল ও অন্যান্য উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের সম্পাদকীয়র একটি চমৎকার শিরোনাম দিয়েছিল, ‘সোনার বাংলার জনক’। সেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবন, রাজনৈতিক উত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে তাঁর ভূমিকা এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বিষয় উঠে আসে।
১৮ আগস্ট ভারতের বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক যুগান্তর তার প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশের (হত্যাকাণ্ডের) ঘটনায় সমগ্র বিশ্বের প্রতিক্রিয়া’। সেখানে বলা হয়, ইউরোপীয় দেশ হিসেবে পোল্যান্ড সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ জানায়। প্রতিক্রয়ায় দেশটি বলেছে, বামপন্থি ও চীনপন্থি শক্তির এই ক্যুতে হাত ছিল। এই শক্তি দেশব্যাপী হত্যা, সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
আরও পড়ুন- মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আর নেই
পশ্চিম জার্মানির নেতা নোবেল বিজয়ী উইলি ব্র্যান্ডট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি আর বিশ্বস্ত থাকতে পারে না। যে বাঙালিরা মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যে কোনো ঘৃণ্য অপরাধও করতে পারে।’ জাতির স্বপ্নদ্রষ্টাকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি বিশ্বের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্র প্রকাশ করেছে।
ফ্রান্সের দৈনিক হিউম্যানিটি মন্তব্য করে, ‘বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের ঘটনা মনে হচ্ছে পূর্বপরিকল্পিত। এই ক্যুর পেছনে আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া খন্দকার মোশতাক ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
২৮ আগস্ট প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনের পর বাংলাদেশের মানুষ দৃশ্যত সামরিক আইন ও ধর্মীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছে।
১৬ আগস্ট আরেক ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফে বলা হয়- ‘বালাদেশের কোটি কোটি মানুষ শেখ মুজিবের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ আরেক ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য টাইমস’ ১৬ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদে বলেছে, “সকল কিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সব সময় এ কারণে স্মরণে থাকবেন, তাঁকে ছাড়া বাঙালি তার নিজস্ব স্বাধীন সার্বভৌম সত্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারত না।”
আরও পড়ুন- বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা
আর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জোর দিয়ে বলেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না’।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের পর সেনা সমর্থিত সরকার বিশ্বাস করে, ক্ষমতা গ্রহণে তারা ইসলাম ও পশ্চিমাদের সমর্থন পাবে।’
সোভিয়েত সংবাদমাধ্যম, ইজভেস্তিয়া কোনো মন্তব্য ছাড়াই ভেতরের পাতায় ক্যুর খবর প্রকাশ করে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদায় বলা হয়, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিকূল শক্তি হয়তো দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলবে।
সূত্র : বাসস ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যম