কোনও মামলার আসামি না হয়েও জেল আর হয়রানির শিকার হতে পারেন যে কেউ। এর কারণ ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নিরীহ প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে এই বেআইনি পন্থা বেছে নেন অনেকে। টাকার বিনিময়ে একশ্রেণির দালাল চক্র ও আদালতের অসাধু কর্তারা তাদের সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ।
গ্রেফতারি পরোয়ানা আসল নাকি নকল আদালতে তা যাচাই-বাছাই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণে কেউ নির্দোষ হলেও কারাগার থেকে বের হতে লেগে যায় অন্তত এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময়।
সম্প্রতি (গত শুক্রবার/১৮ মার্চ -দুপুরে) এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার রায়পুর কাজিরচর গ্রামের পানদোকানি আবদুল কাদের (কালু) (৩৫)। তার বিরুদ্ধে কোনও থানা বা আদালতে মামলা নেই। তবুও ভুয়া পরোয়ানার কারণে ৪দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে তাকে। তার বাবার নাম নুরুর হক।
পুলিশ জানান, ডাকে আসা পরোয়ানা নকল না আসল তা যাচাইয়ের কোনও পন্থা নেই। মামলার নথি না দেখে পুলিশ কখনও ভুয়া পরোয়ানার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে না। আর সেই মামলার নথি যদি এক জেলা থেকে আরেক জেলায় থাকে, তা খুঁজে তলব করে দেখতে অনেক সময় লাগে আদালতের। ততদিন গ্রেফতার ব্যক্তিকে থাকতে হয় কারাগারেই। পরোয়ানা নকল হলেও এ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এক্ষেত্রে পুলিশ ছেড়ে দিতে পারে না। তারা কেবল আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করে থাকেন। এ ধরনের ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানার কারণে প্রায়ই অসহায় মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে স্বীকার করেছেন পুলিশ।
লক্ষ্মীপুর জেলা জজ আদালতের আইজীবি মোঃ শাকিল পাটোয়ারী দাবি করেন-দেশের আদালতগুলোতে একশ্রেণির অসাধু দালাল চক্র এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। ‘কখনও কখনও আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এটা প্রতিরোধ করা দরকার।’
জানা যায়, গত ১৮ মার্চ দুপুরে (জুমার নামাজের সময়) রায়পুরের মিতালি বাজার থেকে আবদুল কাদেরকে (কালু) গ্রেফতার করেন ওই থানার এএসআই আফজাল।গ্রেফতারের সময় এএসআই জানান, বরিশালের কোতুয়ালী থানার দুটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তারিপরোয়ানাভুক্ত আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে আদালতের পরোয়ানা রয়েছে। পরোয়ানায় কতোয়ালী থানার ২টি মামলা নম্বর ২২৬/২১ (৪ কেজি গাঁজা) এবং ৯২৫/২১ (১৫ গ্রাম গাঁজা)।
অসহায় নিরিহ একজন পানদোকানি জেনে এলাকাবাসীর সঙ্গে তার পরিবারও হতবাক। তারা ভাবতেই পারেননি আবদুল কাদের কালুর নামে এমন মামলা থাকতে পারে। এছাড়া পুলিশ জানায়, তিনি নাকি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক।
গ্রেফতারের পরে রায়পুর থানা পুলিশ লক্ষ্মীপুর আদালতে সোপর্দ করে আবদুল কাদের কসলুকে। এরপর তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন লক্ষ্মীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। পরবর্তী সময়ে ওই মামলার কাগজ নিয়ে আদালতে আসেন আবদুল কাদেরের স্বজনরা (বাবা ও স্ত্রী)। তারা এডভোকেটের মাধ্যমে জানতে পারেন ওয়ারেন্টে নাম আছে কিন্তু দুটি মামলায়ই তার নাম নেই।
দুই মামলার বাদী বরিশালের কতোয়ালী থানার পুলিশ কর্মকর্তা ফিরোজ আলম ও মেহেদী হাসান । পৃথক দুই মামলার মামলার আসামি ৬জন। তারা হলেন, মোঃ নয়ন ও খাদিজা আক্তার জুথি এবং সোহাগ মোল্লা, নাঈম হাওলাদার, টিটু বেপারি ও মোঃ রুবেল। জিআর ৯২৬ মামলায় গত বছর দুই জনেরই সাজা হয়। ওয়ারেন্ট আসে ৮দিন আগে।
মামলা দুটি মূলত মাদক মামলা। মামলায় আসামি ৬ জন থাকলেও আবদুল কাদেরের নাম নেই। কিন্তু ওয়ারেন্টে তার নাম দিয়ে ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করে নাম-ঠিকানা লিখে রায়পুর থানায় পাঠানো হয়। সেই অনুযায়ী তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পান দোকানি আবদিল কাদেরের কৃষক বাবা নুরুর হক ও স্ত্রী. নয়ন বেগম লক্ষ্মীপুর আদালতে এসে পরোয়ানার ফটোকপি নিয়ে আইনজীবী শাকিল পাটোয়ারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জেলা জজ আদালতে মামলা দুইটির বিষয় খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন।
শাকিল পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা মামলা নম্বর নিয়ে বরিশাল আদালতে ও কতোয়ালী থানায় খবর নিই। ২০২১ সালের মামলা হওয়ায় থানা থেকে তেমন কিছু জানাতে পারেনি। এরপর খোঁজ নিয়ে মামলার নথি বের করেন আদালত থেকে।’
আইনজীবী শাকিল পাটোয়ারী বলেন, আবদুল কাদের কালুর পরিবার মামলা নম্বর নিয়ে এলে আমার নীজেই খোঁজ নেই। মামলার নথি দেখি। ১টি মামলার রায় হয়ে গেছে। অন্যটি বিচারাধীন। দুটি মাদক মামলায় আবদুল কাদের কালুর নামে কোনও আসামি নেই। তখন বিষয়টি আমরা আদালতে আবেদন করে উত্থাপন করি। এরপর তাকে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভিক্টোরিয়া চাকমা (আমলী অঞ্চল রায়পুর) জামিন দেন।’
এটি ভুয়া পরোয়ানা ছিল বলে জানান এই আইনজীবী। তার কথায়, ‘এ ধরনের ঘটনা আগে কখনও পাইনি। এই প্রথম। আমি তো হতবাক। এর সঙ্গে আদালতের দালালরা জড়িত। তারা টাকার বিনিময়ে এগুলো করে। আইনজীবীরাও জড়িত থাকতে পারেন।’
ভুক্তভোগী আবদুল আলী কালুর বাবা নুরুর হক বলেন, ‘বাইরে আমার কোনও শত্রু নেই। তবে কারও নাম বলতে পারছি না। আমি মিতালিবাজারে পান দোকান দিয়ে কন রকম বেঁচে আছি। বিপদে পড়লে আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে। অপরাধ নাকরে ৪দিন জেল খেটেছে ছেলে।’
রায়পুর থানার এসআই মোঃ এরফান ও এএসআই আফজাল হোসেন জানান, অন্য জেলা থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা সবসময় পুলিশ সুপারের কার্যালয় আসে। তিনি তা প্রথমে গ্রহণ করেন। এরপর সেটি ঠিকানা অনুযায়ী বিতরণ হয় থানাগুলোতে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তা থানার রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত করে আসামিকে গ্রেফতারের জন্য এসআই বা এএসআইকে নির্দেশ দেন।পর তারা আসামিদের গ্রেফতার করে থাকেন।
এসআই এরফান বলেন, ‘পান দোকানির বিষয়ে এই নিয়ম মানা হয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানাগুলো সব একই রকম। কোনটা আসল কোনটা নকল তা কিন্তু যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ হয়না থানা পুলিশে।