দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যা ২৪ ঘণ্টায় আরও এক জেলায় বিস্তার লাভ করেছে। উজানের ঢলে দুধকুমার ও ধরলার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছানোর ফলে নদ-নদী তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া আগে থেকে নীলফামারী, লালমনিরহাট ও নেত্রকোণায় বন্যা চলছে। এসব জেলায় হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি।
এতে শুক্রবার (১৪ জুলাই) সন্ধ্যা পর্যন্ত৷ শুধু কুড়িগ্রামেরই ৯ উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। শুক্রবার এ জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায় একটি সড়ক উপচে ভেসে গেছে কয়েকটি গ্রাম। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বন্যা দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার পাশাশি ত্রাণ সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
আরও পড়ুন- কুড়িগ্রামের তিস্তা পাড়ের মানুষের এ দুঃখের শেষ কোথায়?
শুক্রবার (১৪ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৫ ও ধরলার পানি শহরের সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
বানভাসিদের কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবার কেউবা বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। গবাদিপশু নিয়েও তারা পড়েছেন চরম বিপাকে।
তবে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা গেছে, প্লাবিত এলাকার বেশিরভাগ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসতবাড়িতে অবস্থান করছেন। জিনিসপত্র ও গবাদি পশু সরাতে না পারায় তারা বাড়ি ত্যাগ করছেন না।
এদিকে, দুর্গত এলাকার কিছু পরিবারকে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা জানিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার ৯ উপজেলার প্রাথমিক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এতে ৪১ ইউনিয়নের ১৭০ গ্রামের প্রায় ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে নাগেশ্বরী। এই উপজেলার ৯ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে দুই হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়েছে।
আরও পড়ুন- মদনে জাতীয় পার্টির দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার জেলার প্রায় ৭০০ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নাগেশ্বরী, রাজারহাট, উলিপুর উপজেলার কিছু প্লাবিত এলাকা থেকে দুর্গত মানুষদের সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পশুখাদ্য যেন ঘাটতি না হয়, সে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। দুর্গতদের উদ্ধারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌকা ও স্পিডবোট প্রস্তুত রয়েছে।’
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ধরলা ও দুধকুমারে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগামী ২/৩ দিন পানি বেড়ে জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। পূর্বাভাস অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। এরপর পানি দ্রুত নেমে যাবে।’
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানিয়েছে, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলে হওয়া ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসায় এ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খরব-
ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম): ধরলা, বারোমাসিয়া, নীলকমলসহ সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। শেখ হাসিনা ধরলা সেতুর পশ্চিম পাড়ের দক্ষিণ সোনাইকাজী সৌহার্দ্য বাজার যাওয়ার সড়কটি ধরলার পানির তোড়ে তিন জায়গায় ভেঙে গেছে। এতে প্রায় ৩০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গোরকমন্ডল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে হাঁটু পানি। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে পশ্চিম ধনিরামের মাঝের চরের প্রায় ২০০ পরিবারের বসতঘর। বানভাসিরা শুকনা খাবার খেয়ে আপাতত ক্ষুধা নিবারণ করছেন। উপজেলা সদরের নাওডাঙ্গা পুলের পাড়ের নির্মাণাধীন সেতুর বাইপাস সড়কের লোহার সেতুটি ডুবে যাওয়ায় তিনটি ইউনিয়নের সঙ্গে ফুলবাড়ী উপজেলার যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন- দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ওপরে, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
কুড়িগ্রামঃ সদর উপজেলার অনেক গ্রামে বাড়ির উঠানে পানি উঠে তলিয়ে গেছে রান্নাঘর। এমতাবস্থায় অনেক পরিবারকে চাল ভাজা, মুড়ি, চিড়া বা অন্যান্য সব শুকনো খবার খেতে দেখা গেছে। এই খেয়েই কাটছে তাদের দিন। বন্যা হলেই এমন দুর্দশা হয় এসব পরিবারে।
দক্ষিণ ভগবতীপুর গ্রামের গৃহবধূ নার্গিস জানান, গত চার দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় আছেন তারা। কেউ তাদের খোঁজখবর নেয়নি এখনো। ঘরের চৌকিতে পানি ওঠায় পার্শ্ববর্তী এক উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। এই গ্রামে প্রায় ৪৫-৫০টি বাড়িতে পানি উঠেছে।
নাগেশ্বরী উপজেলার পানাপিকারী থেকে বড়মানি সড়ক উপচে শুক্রবার কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের চরকাফনা গ্রামের নুর বখত জানান, নিচু এলাকার বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। লোকজন গবাদিপশু নিয়ে শঙ্কায় আছেন। এই গ্রামের গৃহবধূ নাজমা জানান, চারদিকে পানি থাকায় ঠিকমতো রান্নাবান্না করতে পারছি না।
লালমনিরহাটঃ তিস্তা ও ধরলা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পাঁচ উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণে নতুন করে ১১০ মে. টন চাল ও চার লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার দুপুর ১২টায় শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ২৫ সে. মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বেলা ৩টায় তা কিছুটা কমে বিপৎসীমার ২০ সে. মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, উজানের ঢলে পানি বাড়ছে। তবে পানি বাড়লেও তা স্থায়ী হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নে ছয়টি ওয়ার্ডে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
আরও পড়ুন- তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে, আতঙ্কে স্থানীয়রা
ডিমলা (নীলফামারী): তিস্তার ঢলে প্লাবিত হয়েছে নীলফামারীর ১৫টি গ্রাম। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা বিপৎসীমার ৪০ সে. মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি চরে বসতবাড়িতে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন ওইসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা। গ্রামগুলোর বাসিন্দারা বৃহস্পতিবার রাত থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেছেন। খালিশা চাপানি ইউপি চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান কেনজুল বলেন, বন্যায় ছোটখাতা ও বাইশপুকুর গ্রামের সহস্রাধিক পরিবারের বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতীফ খান জানান, তার ইউনিয়নের দুটি গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবারের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে। সরকারিভাবে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া আছে। তালিকা পাওয়ামাত্রই ত্রাণ বিতরণ করা হবে।