নিজস্ব প্রতিবেদক :
মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও সদরসহ চার উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। হঠাৎ নদীর পানি ৫-৬ ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ১১ হাজার হেক্টর জমির ফসলসহ গবাধিপশু, মুরগির পোল্ট্রি খামার ও শতাধিক মাছের ঘের ক্ষতির শিকার হয়েছে। বুধবার (৫ আগস্ট) বিকেলে আচমকা মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারে এমন ক্ষতির শিকার হন উপকূলের বাসিন্দারা। বেড়ি বাঁধ না থাকায় পূর্ণিমার প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়দের দাবী।
বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) ও শুক্রবার (৭ আগস্ট) ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলো পরিদর্শন করে ও ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার পরিবারগুলোর তালিকা করে আর্থিক সহায়তার জন্য রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগণ জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরণ করেছেন।
সূত্রে জানা যায়, জেলার রায়পুর থেকে সদর ও কমলনগর হয়ে রামগতি উপজেলা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার নদীর তীর এলাকা। মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে নদীতে বিলিন হয়ে গেছে বেড়িবাধ। তাই অরক্ষিত হয়ে পড়ে এসব এলাকা। হঠাৎ বুধবার (৫ আগস্ট) বিকেলে মেঘনা নদীর জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৬ ফুট বেড়ে যায়। এসময় তীব্র বাতাস ও স্রোতে নদীর পানি হু-হু করে ঢুকে পড়ে উপকূল এলাকায়। মুহূর্তেই বিস্তীর্ণ জনপদ পানির স্রোতে ভেসে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা সদরের করাতিরহাট, চর রমনি মোহন, ভূঁইয়ার হাট, চর মেঘা, রায়পুরের চর আবাবিল, খাসের হাট, চর লক্ষ্মী, চর বংশী, চর ভৈরবী, হাজীমারা, চর কাচিয়া, জালিয়ার চর, কুচিয়া মোড়া, চর ঘাশিয়া, টুনুর চর, কমলনগরের চর ফলকন, চর কালকিনি, চর লরেন্স, নবীগঞ্জ, নাছিরগঞ্জ ও রামগতি উপজেলার চর আবদুল্লাহ, চর গজারিয়া, চর গাজী, চর আলগী, বড়খেরী, তেলীর চর, আলেকজান্ডার, বালুর চর, সুজন গ্রাম, জনতা বাজার, সেবা গ্রামসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। নদীর তীর থেকে এসব এলাকার প্রায় ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে নদী সংযুক্ত খাল, পুকুর, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয়-প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট হাঁটু পরিমাণ পানিতে ডুবে আছে। শত শত বসতঘরে পানি ঢুকে ক্ষতি হয়েছে আসবাবপত্র ও বিভিন্ন মালামাল। এতে মেঘনা উপকূলীয় মানুষগুলো চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।
এদিকে রায়পুর উপজেলায় কয়েকটি মৎস্য ঘেরের প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাছ জোয়ারে ভেসে গেছে। উপজেলার চর আবাবিলসহ কয়েকটি গ্রামের অন্তত ৩ হাজার পানের বরজ পানিতে তলিয়ে গেছে। পান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষীরা। এছাড়াও ৫ শতাধিক ঘর-বাড়ি পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
অপরদিকে কমলনগরের চর লরেন্স ইউনিয়নের ‘তাজ পোল্ট্রি খামারের’ সাড়ে ৫ হাজার মুরগী জোয়ারের পানিতে ডুবে মারা গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে মুরগির খাবার। এতে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে খামারী মো. ওসমানের। খামারী মো. ওসমান জানান, দশ মিনিটের জোয়ারে তার পুরো মুরগির খামার লন্ড ভন্ড করে দিয়েছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে তার খামারের মুরগিগুলো মরে গেছে। মোটা অংকের ঋণ নিয়ে খামারটি করেছিলো সে। ঋণের টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। মেঘনা আমাকে নিঃশ্ব করে দিয়েছে বলে তিনি জানান।
জেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারি কর্মকর্তা আবুল হোসেন শীর্ষ সংবাদকে জানান, মেঘনার অস্বাভাকি জোয়ারে লক্ষ্মীপুর জেলার ৪টি উপজেলা আউশ, রোপা আমন, বোনা আমন ও শাকসবজিসহ ১১ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নিমজ্জিত হয়েছে। এতে রোপা আমনের ৩৭৫ হেক্টর জমির বীজতলাও নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ক্ষতির পরিমান সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন্যা মোকাবেলায় জিআর নগদ ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, জিআর চাল ৩৫০ টন, গোখাদ্যের জন্য ৬ লক্ষ টাকা, শিশু খাদ্যের জন্য ২ লক্ষ টাকা, শুকনা খাবার ২ হাজার প্যাকেট মজুদ রাখা হয়েছে। এছাড়াও কবলিত এলাকর মানুষের আশ্রয়ের জন্য ৫ উপজেলায় ১০১টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র খোলা রয়েছে।
রায়পুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মানুনুর রশিদ শীর্ষ সংবাদকে জানান, জোয়ারের কারণে ৪ ইউনিয়নের বেশ কিছু কাঁচা, আধাপাকা ঘরবাড়ি ও সড়কের গাছসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব এলাকায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করা হয়ে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলোকে শুকনা খাবারসহ সহ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোবারক হোসেন শীর্ষ সংবাদকে জানান, জোয়ারের পানিতে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ২৫ হাজার পরিবারের ৬০ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ে। এতে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সহায়তা চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এদিকে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুল মোমিন শীর্ষ সংবাদকে বলেন, মেঘনার হঠাৎ জোয়ারে ৬টি ইউনিয়ন ও রামগতি পৌরসভার আংশিক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে ঘর-বাড়ি, গবাদিপশু ও ফসলী জমিসহ ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে ১০ হাজার পরিবারের মধ্যে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তাদের তাৎক্ষনিক কিছু শুকনা খাবার দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক নিকট ত্রাণের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। বরাদ্ধ পেলে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
তবে শুক্রবার (৭ আগস্ট) পর্যন্ত মেঘনার জোয়ারে প্লাবিত এলাকাগুলোর পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে বলে কমলনগর উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি মাষ্টার নুরুল আমিন জানিয়েছেন।