আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সফি উল্লা। তিনি অনেকটা সংসারে অমনোযোগী ছিলেন। আমাদের পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা গুলো প্রায় সময় মামারা দেখাশুনা করতেন। বাবা ছিলেন ওমান প্রবাসী এবং সেইখানে তার একটি ওয়ার্কশপ ছিল। বাবা প্রায়ই ওমানে অবৈধ বাঙ্গালীদের আশ্রয় এবং তাদের কর্মসংস্থান-এর ব্যবস্থা করে দিতেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে যেকোনো মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতেন এবং ভালোবাসতেন। এজন্যে তার জীবনের অধিকাংশ সময় ধোকা খেতে খেতে গেছে।
একটা সময় বাবা কাপ্তাই, কর্ণফুলি পেপার মেইল চাকুরী করতেন। ১৯৭১ সালে যখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে স্বল্পকালীন ট্রেণিং নিয়ে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী তথা যুদ্ধকালীন ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে দেশের জন্যে যুদ্ধ করেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে আমার বড়ভাই মাহফুজ তখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলেন। ওই সময় অনেকেই আমার মাকে বলতেন তোর স্বামীতো শেষ হয়ে যাবে, তুমিতো অকালে বিধবা হয়ে যাবা। মা তাদের বলতো সমস্যা নাই আমার পেটের সন্তান নিয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবো। এইভাবে যুদ্ধের দিন গুলো অস্থীরতার মাধ্যমে শেষ হয়। যুদ্ধ শেষে আমরা পেয়ে গেলাম স্বাধীন দেশ তথা লাল সবুজের পতাকা।

এবার আসি মূল কথায়, বাবা ১৯৯১ সালে বিদেশ যায় তখন আমি ৩য় শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলটি ছিল নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলার কালামুন্সি বাজারের কবি জসিম উদ্দিন একাডেমী। তবে বাবা সাংসারিক জীবনে অনিয়মিত টাকা দিতেন। যার দরুন পরিবারে আমরা মা, দাদী ও ছয় ভাই এর ভরন পোষণ অনেকটা কষ্টকর হয়ে যেতো।
আমার স্কুল জীবনটা কষ্টের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়। হাই স্কুলটি ছিল আমার বাড়ী থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অর্থাৎ মিয়ারহাট উচ্চ বিদ্যালয়। ওই সময় কাঁচা রাস্তা প্রতিদিন প্রায়ই ৪ কিলোমিটার আসা-যাওয়ায় ৮ কিলোমিটার হেটে গিয়ে লেখা-পড়া করতাম। আশপাশের অনেক সহপাঠী সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে একটা বাইসাইকেল কেনার সামর্থ্য ছিলো না।
ওই সময় মোবাইল ছিলো নানা। বাবাকে চিঠি লিখতাম কিন্তু তেমন রেসপন্স পেতাম না। কারণ বাবা ওই খানে মানবিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মাঝে মাঝে যে টাকা দিতেন তাতে মানুষের ঋণ দিলে খুব একটা থাকতো না।
স্কুলে যাওয়ার সময় খালি পকেট অর্থাৎ টাকা ও টিফিন ছাড়া যেতাম। যারা সচ্ছল বন্ধু ছিলো তাদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। কারণ তাদের মতো আমার পরনে পোষাক ছিলো না এবং সমাজ রক্ষা করার আমার সেই পরিবেশে তথা পকেটে টাকা ছিল না। টিফিন বিরতি ছিলো ঠিক, কিন্তু টিফিন ভাগ্যে জুটতো না। এমনকি স্কুলের ঠিক মতো বেতন-ফিস পরিশোধ করতে কষ্ট হতো। যার জন্যে পরীক্ষার সময় অনেক সময় স্কুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো অফিসের বারান্দায়। এর মধ্যে ২০-২৫ মিনিট যাওয়ার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার অনুমতি দিতো। তবে লেখাপড়াতে ভালো ছিলাম, যার দরুন কিছু সহপাঠী খোঁজখবর নিত।
একদিন স্কুলে বিনা বেতনের জন্যে আবেদন করি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাক্ষাৎকারের সময় বললো তোমার বাবা কি করেন? আমি বলেছি প্রবাসে থাকেন। কারণ আমি ছোটবেলা থেকে কখনো মিথ্যা বলতাম না। তখন তিনি বিনা বেতন মঞ্জুর করেন নাই। অথচ আমার এক সহপাঠী তাকে জিজ্ঞাস করলেন তার বাবা কি করেন, সেই বলেছে আল-আমিন বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন, অথচ সেই বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলো।
এইভাবে কেটে গেল স্কুল জীবন তৎকালীন ১৯৯৮ সালে মানবিক বিভাগ থেকে দুই বিষয়ে লেটার পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হই। ইচ্ছে ছিলো উচ্চ শিক্ষায় নিজেকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বেশি দূর যেতে পারিনি। হঠাৎ একদিন পুলিশের সার্কুলার পাই কনস্টেবল পদে। তখন আমার দুই মামা আকবর-বাবর তারা ছিলো পুলিশ কনস্টেবল কিন্তু তাদের টাকা-পয়সা ছিল। কিছু সময় তাদের নিয়ে ভাবলাম। চিন্তা করলাম তারা সচ্ছল পরিবারের হয়ে কনস্টেবল পদে পুলিশে চাকুরী করতেছেন তাহলে আমি কেন নই।
তখন মাকে না জানিয়ে মাইজদী পুলিশ লাইনে দাঁড়ালাম। প্রায়ই ৭-৮ শত লোক দাঁড়ালেন লাইনে। চাকুরী হবে কিনা জানি না। ইচ্ছে ছিলো তাই দাঁড়ালাম। সারাদিন যাচাই-বাছাই শেষে রাত ১০ টার সময় রেজাল্ট দিলো সবমিলিয়ে ৩৫ জন মেধা তালকায় আমি ৮ম হয়েছি। তখন সোজা প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ীতে চলে আসি। মা সারাদিন বাড়ীতে না পাওয়ায় খুব রাগ, মনে হচ্ছে লাঠি দিয়ে পিটাবে। কিন্তু যখন মাকে জড়িয়ে হাসি মুখে বললাম মা আমার পুলিশে চাকুরী হয়েছে তখন মা এর দুচোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তে থাকলো। আমার মা আমাকে খুব দোয়া করতেন, তবে আমাকে নিয়ে ভয় করতেন কারণ আমি শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে পারতাম না।
চাকুরী জীবনটা শুরু করি সিলেট থেকে। দীর্ঘ প্রায়ই ১৪ বছরের মতো সিলেটে ছিলাম পেয়েছি মানুষের অফুরান ভালোবাসা। আমি ২০০৮ সালে SMP, sylhet কনস্টেবল হতে ASI(Assistant Sub-Inspector) বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা দিয়ে ১০২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মেধা তালিকাতে ২য় স্থান অধিকার করে যথাসময়ে এএসআই পদোন্নতি লাভ করি এবং ২০১৩ সালে একই ইউনিট অথাৎ (SMP,Sylhet) বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা দিয়ে যথারীতি ২য় স্থান অধিকার করে যথা সময়ে এসআই(Sub-Inspector) পদোন্নতি লাভ করি। আমার চাকুরীকালীন নিয়োগ, পদোন্নতি কোথাও অর্থ দিতে হয়নি। বর্তমান অবস্থার জন্যে মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
আমি ২০১৬ সালে ১লা মে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায় যোগদান করি। যোগদানের অল্প দিনের মধ্যে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। যাহা সারাজীবন মনে থাকবে। মনে থাকবে রামগঞ্জের কিছু অসহায় প্রতিবন্ধী, হতদরিদ্র মানুষ যারা আমাকে তাদের অন্তরের সিংহাসনে স্থান দিয়েছেন। তাদেরকে কখনো ভুলবো না। পাশাপাশি রামগঞ্জবাসির নিকট কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, আমার বদলী প্রাক্কালিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালোবাসাসহ এমনকি মানববন্ধন করে আমাকে রাখতে চেয়েছেন।
ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া করে অনেক বড় হওয়ার। কিন্তু আর্থিক অচ্ছলতার কারণে ইচ্ছে গুলো বাস্তবতায় চাপা পড়ে যায়। তবে ২০০১ সালে কনস্টেবল পদে চাকুরীতে যোগদান করি। কিন্তু যত কষ্ট ও ব্যস্ততার মাঝে লেখাপড়া চালিয়ে যাই সবমিলিয়ে স্নাতক পর্যন্ত পড়া সম্ভব হয়েছে।
২০০৬ সালে Rab-8, বরিশাল কর্মরত থাকালীন সম্পর্কের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন শুরু। বর্তমানে আমাদের এক ছেলে (৬ষ্ঠ শ্রেনী) এবং এক মেয়ে (৩য় শ্রেনী)। আলহামদুল্লািহ, আমার পরিবারের খুব একটা চাহিদা কিংবা বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন নাই। ইচ্ছে আছে দেশকে নিয়ে কিছু করার,বাকীটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে।
আমি জীবনে প্রথম পুলিশে দাড়াই, আলহামদুল্লািহ সফলতা লাভ করি এবং পদোন্নতি পরীক্ষাতেও প্রথমে পদোন্নতি লাভ করি। অর্থ কিংবা ঘুষ ছাড়া।
চাকুরীর শুরু থেকে কখনো মা-বাবার অবাধ্য হয়নি। বেতনের একটি অংশ আমার মা-বাবার। কারণ তাদের জন্যে আজকে আমি পুলিশ। স্বপ্ন আছে আমার মতো যারা সংগ্রামী জীবনে সহযাত্রী তাদের নিয়ে তথা অসহায় হতদরিদ্র, শারীরিক প্রতিবন্ধী গরীব মানুষদের জন্যে কিছু করার। এই জন্যে সকলের দোয়া কামনা করছি।
আমরা অনেকেই অতীতকে সহজে ভুলে যাই। কিন্তু কেন? একটা কথা সবার মনে রাখা উচিত, আমাদের সবার ঠিকানা এক জায়গায়, শেষ বিচার হবে একমাঠে যার নাম হাশরের ময়দান।
আমার অতীত আমার শক্তি, আমার অতীত আমার জীবন চলার অনুপ্রেরণা।
আমার গর্ব আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, আমি গর্বিত আমি একজন পুলিশ সদস্য। কারণ পুলিশ জনগণের প্রকৃত সেবক। চাইলে হয়রানি এবং উপকার দুইটা পুলিশ করতে পারে।
(আমার এই বাস্তব জীবনের গল্প, শেয়ার করলাম তাদের জন্যে, যারা জীবন যুদ্ধে লড়াকু সৈনিক, তাদের জন্য, যাতে তারা অনুপ্রানিত হয় যুদ্ধের ময়দান থেকে হাল না ছাড়ে)।
লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
শীর্ষ সংবাদ/আপ্র