প্রাকৃতিক দুর্যোগ “করোনা “গোটা বিশ্বের মানচিত্রের গর্বিত সীমারেখাকে বিলীন করে মানবসত্তাকে এনেছে এক কাতারে। সমস্ত মানব জাতি আজও ধুঁকছে তারই তা-বে। দৈনন্দিন জীবন হয়ে উঠেছিল আতংকিত মৃত্যুর করাল থাবায়। মাস্কের আড়ালে জিহবা হয় উঠেছিল আড়ষ্ঠ। গৃহবন্দি শিশুদের স্থবিরতায় বাড়ির আঙিনা, খেলার মাঠ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল প্রাণহীন।
শিশুর শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য হীনতার বিষয়টি চোখে পড়ার মত ছিল যা এখনও তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পাশাপাশি উপরের ক্লাসে উত্তীর্ণের কারণে প্রায় দুবছরের শিক্ষণবঞ্চিত শিশুদের অবস্থা কেমন হতে পারে তা অনুমেয়। সপ্তাহে একদিন/দুদিন করে পর্যায়ক্রমে যখন শ্রেণিতে পাঠদান শুরু হলো শিশুদের আচরণ সাধারণ ছিল না। শিখনঘাটতি নিরসনে সরকারি আদেশ মতে কাজ শুরু হলো তবুও কোথায় যেন শিশুরা থেমে গিয়েছে মনে হত। কাজে মোটেও আগ্রহ নেই, খেলতে দিলেও কিছুক্ষণ পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, মাস্ক মুখে রেখে কথা বলার কারণে কথা স্পষ্ট বোঝা যেত না; আবার কারো কারো কথা বলতে শ্বাসকষ্ট হত। শ্রেণিতে ঘুমিয়ে পড়তো অনেক শিশু। করোনা নিয়মাবলিতে আসলে তারা ক্লান্ত।
ক্লাসের ধারাবাহিকতা যখন মোটামুটি শুরু হলো মূল সমস্যা দেখা দিল তখনই- ফোনালাপে হোমভিজিট, ওয়ার্কশিট, গুগলমিট তেমন কাজে আসেনি বোঝা গেল। পাঠ্যক্রম কমিয়ে দিলেও পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী শ্রেণির মাঝখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যেন বন্দিদশা! শিক্ষণে দেখা দিল জটিলতা। যারা ২য় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলো অটো প্রমোশনে তাদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ, তবে সার্বিকভাবে দেখা গেল অধিকাংশ শিশু বাংলা বর্ণ চিনতে পারছে না, বানান করেও পড়তে পারছে না, লিখতে পারছে না, গণিত এবং ইংরেজির অবস্থা এর চেয়েও কঠিন। পড়াশোনায় চাপ দিলেও শিশু স্কুলে আসবে না রীতিমত দুশ্চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হত সবসময়। একটা শ্রেণিতে যতজন শিশু কমবেশি ততরকম সমস্যা! তার সাথে শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক সমস্যা তো নিত্যসঙ্গী। এদিকে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ায় একটি দুটি করে গ্রাম থেকে শিশুর পরিবার শহরে ফিরতে শুরু করল, অনেক কিন্ডারগার্টেন উঠে গিয়েছে তারাও প্রতিদিন একটি/দুটি করে ভর্তি হতে এলো তাদেরও ফিরিয়ে দেয়া হলো না। এরই মধ্যে শিশুদের নতুন করে জ্বর, সর্দি শুরু হলো। দুশ্চিন্তার পারদ বাড়তে লাগল; কী করা যায়! উত্তরণের পথ কোথায়?
শুরু হলো সবার সাথে শেয়ারিং, পথ একটা পাওয়া গেল শিশুকে কাজের মধ্যে রাখতে হবে – যে কাজে তারা আনন্দ পায়। ছোটখাটো একটা মেলা করা হবে নাম তার, ‘আনন্দে খেলি আর শিখি’।
আরও পড়ুন- পরিবেশ নিয়ে আমরা কতটা সচেতন?
সকলে মিলে মিটিং করে নির্ধারণ করা হলো ১ম পর্যায়ে বেশ কিছু দেশীয় খেলা : বাঘ বন্দি, কড়ি খেলা, গুটিখেলা, পুতুল খেলা, লুডু খেলা, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, গোল্লাছুট, টিপ্পু ইত্যাদি দিয়ে শুরু। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে শিখন ঘাটতিকে ভিত্তি করে সাধারণ সমস্যাগুলোকে কৌশলে উপস্থাপন করে শিখন ঘাটতি দূর করা। যেমন বর্ণ লুডু, শব্দ লুডু, যুক্তবর্ণ, শূন্যস্থান, গল্প বলা, মুখাভিনয়, ছবি আঁকা, সাপল গেইম, অভিধানে শব্দ খোঁজা, বাক্য কার্ড লেখা, অন্তমিল দিয়ে কবিতা লেখা, ছবি দেখে গল্প বানিয়ে বলা, হাতের লেখা, পোস্টার লেখা, গণিত অলিম্পিয়াডের সুন্দর সুন্দর কৌশল যেমন গণনার জন্য আঙ্গুলের ব্যবহার, এক গুটি দুই খেলোয়াড়, দড়িতে সংখ্যা লাগাই ইত্যাদি। ৩য় পর্যায়ে ম্যানিজিং কমিটি, পিটিএ কমিটিকে সেদিন শিশুদের সাথে সময় কাটানোর দাওয়াত দেয়া হবে এবং অভিভাবক সমাবেশ করে তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। খেলাধুলার কথা শুনে উপস্থিতি বাড়তে শুরু করল। ধীরে ধীরে শিশুর কোলাহলে মুখরিত স্কুল প্রাঙ্গণ। সেই পুরাতন নালিশ, আমাকে খেলতে নেয়নি, ও লুডুর গুটি চুরি করে পাকিয়ে নিয়েছে। লম্বা টিফিন টাইম ওদের জন্য আশীর্বাদ বলা যায়।
এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শ্রেণিতে দলের ভিত্তিতে বুঝিয়ে দেয়া হলো। প্রতিটি দলে একজন পড়ুয়া, তার কাজ দলের অন্য সদস্যদের মেলার দিন নব্য পড়ুয়া বানাতেই হবে। আরেক জনের কাজ সঠিকভাবে বর্ণ, কার চিহ্ন শেখানো। বাকি অন্যান্য কাজ সবাই মিলেমিশে করবে। আমার কাজ ছিল প্রতিদিন নির্দেশনাগুলো একবার করে বুঝিয়ে দেয়া এবং কাজের অগ্রগতি জানা। মেলার জন্য প্রচুর কাগজ, কলম, রঙ, বেলুন আরও আনুসঙ্গিক জিনিস দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। অভিভাবকগণ সময়, শ্রম এবং জিনিসপত্র ক্রয় করে দিয়েছেন শিশুদের। সময় অসময় নেই অভিভাবকদের ফোন দিয়েছি তারাও আমায় ফোন দিয়েছেন। এমনও বলেছেন, শিশুরা কাজে এতই মশগুল যে তারা ভিডিও গেইম খেলতে ভুলে গিয়েছে। সমস্ত বাড়ি কাটা কাগজে ভর্তি। উপকরণ বানাচ্ছে তারা। দেখে নিজেরাও বসেছেন পাশে। মেসেঞ্জারে ছবি পাঠিয়েছেন কাজে ব্যস্ত শিশুদের।
টিফিন টাইমে শিশুদের সাথে চলছে খাওয়াদাওয়া আর মেলা আরও আকর্ষণীয় করা যায় কীভাবে এ নিয়ে আলোচনা। এমন সময় প্রধান শিক্ষক এসে আমাদের সাথে টিফিনে অংশ নিলেন এবং জানালেন এসএমসি সভাপতি মেলার দিন আমাদের নাস্তা করাবেন এবং শিশুদের পুরস্কার দেবেন। মেলার দিন দশেক আগে থেকে শিক্ষকগণ ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শিশুদের কাজের অগ্রগতি দেখছেন এবং ফাইনাল করে জমা নিচ্ছেন। দলের উপস্থাপন কীভাবে করতে হবে অনুশীলন করাচ্ছেন। একটু লম্বা সময় নেয়াতে এবং ধীরে ধীরে এগোনোর ফল দেখলাম ভালোই হয়েছে তারা পড়তে পারছে। সবার মাঝে স্বতঃস্ফূর্ততার ছাপ স্পষ্ট। যুক্তবর্ণ আর যুগ্মবর্ণ নিয়ে দুই দলে বাকযুদ্ধ, অভিধান দেখা চলছে, আরেক দল গলদঘর্ম দেয়ালে মানচিত্র টানিয়ে মুশকিলে পড়েছে দু’ঘরে দুই রকম দিক নির্দেশনা আসছে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে আমার দিকে, নম্বর কমে গেলে প্রথম হতে পারবে না তারা এই ভয়ে! এক দলের সজল দারুণ ছবি তুলতে পারে তাকে বেশ সবদলই তোয়াজ করছে, তার ভাবগম্ভীর চেহারা দেখে হাসিই পাচ্ছে। সকলের হাতের লেখা ইতোমধ্যে সঠিক আকৃতি পেয়েছে।
কাজকর্ম গোছানো প্রায় শেষ। ফাইনাল রিহার্সেল চলছে। আগামীকাল ছুটি শেষে মেলা!! এক অভিভাবক আজ টিফিনের বন্দোবস্ত করেছেন।
অনুষ্ঠান সূচি সাজানো হয়েছে। শিশুরা হাতে লিখেছে, “শুভ উদ্বোধন –আনন্দে খেলি আর শিখি। ”
আমাদের সম্মানিত অতিথিরা এলেন। মেলার উদ্বোধন হলো, তারপর শুরু হলো মূল কার্যক্রম। অতিথিগণ ঘুরে ঘুরে কাজ দেখছেন। কোন উপকরণ কোন কাজে কীভাবে তারা ব্যবহার করছে তা জানতে চাইছেন। প্রতিটি দলে প্রায় বিশ ধরনের উপকরণ ছিল। সব দলই জড়তামুক্তভাবে তাদের কাজ উপস্থাপন করেছে। সব শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রধান অতিথি শিশুদের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রশংসা করেছেন কমিটি, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের। শিশুরা সকলেই পুরস্কৃত হয়ে আনন্দিত।
মেলা শেষে মনে হয়েছে শিখন এমনটাই হওয়া উচিত হেসে-খেলে, নেচে-গেয়ে কিন্তু বাস্তবতা অন্যরূপ তার সাথে যোগ দিতে পারাটা সাধনা বটে।
বর্তমানে প্রতিটি শিশু শৈশব থেকে যৌবন লেখাপড়ার পেছনে যেভাবে একটা চক্রবুহ্যের মধ্যে অসম যুদ্ধ করে যাচ্ছে- এর থেকে মুক্ত করা উচিত।
প্রতিটি বাবা-মা এর উচিত ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীকে টেকসই করতে সকল সন্তানের সুশিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করা, বৈষম্যে ভরা শিক্ষার পেছনে নয়, নয় জাগতিক সম্পদের পেছনে।
লেখকঃ মোছাঃ উম্মে সালমা করিম, সহকারী শিক্ষক, রানীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বোয়ালিয়া,রাজশাহী।