বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার কঠিন সংগ্রাম শুরু করে। তখন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল গভীর সংকট এবং অস্থিরতায় ভারাক্রান্ত। মূল্যস্ফীতি আকাশছোঁয়া, ব্যাংকিং খাত জর্জরিত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটাপন্ন এবং দীর্ঘদিনের জ্বালানি সংকট দেশের শিল্প-কারখানার উৎপাদন কার্যত বন্ধপ্রায় অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছিল। এক বছর পার হলেও অস্থিরতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের অর্থনীতি।
তবে এই সময়ে কিছু প্রাথমিক উন্নতির লক্ষণও চোখে পড়েছে। সরকারের কঠোর উদ্যোগ ও নীতিমালা অনুসরণ করে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব অগ্রগতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে জ্বালানি সংকট এখনো বিদ্যমান, বিনিয়োগের প্রবাহ সংকুচিত এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাও দেশের অর্থনীতিকে এখনও পূর্ণ স্বচ্ছলতায় পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে।
মূল্যস্ফীতিঃ বেড়ে যাওয়া জীবনযাত্রার ব্যয় ও মানুষের বোঝা
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান সূচক হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, তখন দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশের কাছাকাছি, যা অর্থনীতির জন্য গুরুতর সতর্কতা ছিল। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছিল। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।
সরকার তার নীতিমালা ও বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নজর দিয়েছে। এক বছরের কঠোর প্রচেষ্টায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে ৮.৫৫ শতাংশে, যা একটি বড় অর্জন। খাদ্য মূল্যস্ফীতিও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, ফলে খাদ্যাভাসে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। এই পরিবর্তন দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রায় সাময়িক প্রভাব ফেলেছে।
তবে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের আবারো ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা ভোক্তাদের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করছে। এর পেছনে গ্লোবাল মার্কেটের তেল মূল্য, জ্বালানি সংকট, খাদ্য উৎপাদনের ব্যাঘাত এবং স্থানীয় সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যাগুলো দায়ী। অর্থাৎ, যদিও সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সফল হয়েছে, তা এখনও স্থায়ী পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না করলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মানে অবনতি ঘটিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ানোর ঝুঁকি থাকবে। তাই এখন সময় বাস্তবমুখী নীতি গ্রহণের, যেখানে বাজারের স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রেখে কার্যকর সমাধান বের করা হবে।
ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠনঃ স্থিতিশীলতার স্বপ্ন ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল সেক্টর হলো ব্যাংকিং খাত, যা বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তারল্য সংকট, দুর্নীতি, অনিয়ম ও সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোকে সুস্থ করার কাজ অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য অতিরিক্ত তহবিল বরাদ্দ ও নতুন পরিচালনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আইনি উদ্যোগ নিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কাজ চলছে।
এই পদক্ষেপগুলোতে অগ্রগতি থাকলেও ব্যাংকিং খাতে অসহযোগিতা ও ঝুঁকি এখনো রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে দেশের বিনিয়োগের পরিবেশে স্থায়িত্ব আসবে না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেছেন, বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক এবং আগামী অর্থবছর পর্যন্ত এই সংকট অব্যাহত থাকতে পারে।
রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভঃ অর্থনৈতিক সুরক্ষা বলয়
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ভরসা প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ পৌঁছেছে ৩০.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২৬.৮০ শতাংশ বৃদ্ধি এই প্রবাহ অর্থনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সুরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ৩০ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার স্পষ্ট ইঙ্গিত। এটি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, আমদানি ও ঋণ পরিশোধে জরুরি মজুদ হিসেবে কাজ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রিজার্ভ দেশের অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা ও স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনে।
তবে, এই প্রবাহকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা এবং বাড়িয়ে নেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ওঠানামা, প্রবাসীদের কর্মসংস্থান পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব এই প্রবাহের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
জ্বালানি সংকটঃ অর্থনীতির বড় বাধা
শিল্প ও উৎপাদনের জন্য জ্বালানি অপরিহার্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, যা শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রণোদনা কমে যাওয়ায় এবং এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) লোনের সীমাবদ্ধতাও শিল্প-খাতে ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান সুদের হার ব্যবসায় ও বিনিয়োগ পরিবেশ সংকীর্ণ করে দিচ্ছে।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানঃ নতুন প্রেরণার অপেক্ষায়
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া দেশের অর্থনীতি টিকতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং উচ্চ সুদের হার ঋণগ্রহণকে কঠিন করে তুলেছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের সুদের হার বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় মূলধন জোগাড় করতে পারছেন না, যা নতুন উদ্যোগ শুরু বা সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বা বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ কমেছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতি ঘটাচ্ছে।
বিনিয়োগের অভাবে শিল্প খাত, উৎপাদন ও সেবা ক্ষেত্রগুলো প্রয়োজনীয় গতিশীলতা পাচ্ছে না, ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বাধা পড়ছে। তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হচ্ছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অর্থনীতিবিদরা সরকারকে করের সহজতা, প্রণোদনা এবং বিনিয়োগ উৎসাহিতকারী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন। বিনিয়োগ পরিবেশ আকর্ষণীয় ও ঝুঁকিমুক্ত করতে ব্যবসায়িক নিয়মনীতি ও অবকাঠামো উন্নত করতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্যও শিল্প খাতকে আরও গতিশীল করতে হবে।
বিদেশি ঋণ-অনুদান ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদেশি ঋণ ও অনুদান গ্রহণের পরিমাণ কমিয়েছে। দেশীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে এই নীতি নেওয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধে সফলতা অর্জন করলেও বাজেট পরিকল্পনায় সংযমী হতে হয়েছে।
ঋণ শোধের ভার দীর্ঘমেয়াদে দেশের আর্থিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সমন্বিত আর্থিক নীতি গ্রহণ জরুরি, যা ঋণ পরিশোধ ছাড়াও টেকসই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।
সামগ্রিক মূল্যায়নঃ আশা ও বাস্তবতার মাঝামাঝি
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করলেও বহু সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আংশিক সফলতা, ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে অগ্রগতি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির ফলে স্থিতিশীলতার ভিত্তি গড়ে উঠছে।
তবে জ্বালানি সংকট, বিনিয়োগ সংকোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির বাধা ও ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বলতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা। সরকারের সামনে কঠোর, সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে কর প্রণোদনা, সহজ ঋণ ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি জ্বালানি সংকটের স্থায়ী সমাধান জরুরি। ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি নির্মূলও অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
এসব ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, আর সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হবে।





