বাংলাদেশ দলে বড় কোনো লেগ স্পিনারের নাম ইতিহাসে খুব বেশি নেই। এ দেশের ক্রিকেটে লেগ স্পিন কখনোই কাঙ্ক্ষিত গুরুত্ব পায়নি। তবুও দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর এক আস্থার নাম হয়ে উঠেছেন রিশাদ হোসেন। রাসেল ডোমিঙ্গো থেকে শুরু করে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে—দুই কোচই মরুভূমিতে লেগ স্পিনের ফুল ফোটাতে চেয়েছেন। কিন্তু সফলতা আসে ধীরে, আসে ধৈর্যের ফল হিসেবে। সেই ধৈর্যের ফল আজ রিশাদ হোসেন। পরিচর্যা, সুযোগ, পরিশ্রম আর ধারাবাহিকতা মিলিয়ে তিনিই এখন বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে একমাত্র লেগ স্পিন অস্ত্র।
রিশাদ হোসেন এখন পর্যন্ত ৩৮টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ৪৭টি উইকেট শিকার করেছেন। উইকেট সংখ্যার ভিত্তিতে তিনি এখন দেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এই ফরম্যাটে মাত্র ৯টি ওয়ানডে খেলা রিশাদের ক্যারিয়ারে টি-টোয়েন্টিই মূল ভরসা। ২ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতায় যে জায়গায় উঠে এসেছেন, তা চোখে পড়ার মতো। তাঁর স্ট্রাইকরেট ১৬.২, অর্থাৎ তিনি প্রতি ১৬.২ বল পর পর একটি করে উইকেট তুলে নিচ্ছেন। গড়ও চমৎকার—২১.৮০।
লেগ স্পিনারেরা সাধারণত উইকেটের খোঁজে থাকেন, রান আটকানো তাদের প্রথম লক্ষ্য নয়। কিন্তু যদি কেউ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি রানও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তবে তিনি হয়ে উঠেন ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’। রিশাদ এই পথে হাঁটছেন। যদিও তাঁর ইকোনমি রেট এখনো কিছুটা বেশি—৮.০৪। তবে উন্নতির আশা রয়েছে, কারণ প্রতিটি ম্যাচেই তিনি নতুন কিছু করে দেখানোর চেষ্টা করছেন।
শ্রীলঙ্কা সফরে রিশাদের পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। প্রথম ম্যাচে ইকোনমি রেট ছিল ৬.০০, দ্বিতীয় ম্যাচে আরও ভালো—৫.৪০, আর তৃতীয় ম্যাচে কোনো উইকেট না পেলেও রানের হিসাব ছিল চমৎকার, ইকোনমি মাত্র ৫.০০। এর আগে পাকিস্তান সফরে দুই ম্যাচেই বেশ রান দিলেও, তৃতীয় ম্যাচে সুযোগ না পেয়ে পরে নিজেকে মেলে ধরেছেন পুরোপুরি। এটাই একজন লড়াকু খেলোয়াড়ের পরিচয়।
বাংলাদেশ দলের অন্য বোলারদের সঙ্গে তুলনা করলেও রিশাদের পারফরম্যান্স বেশ আলাদা। সাকিব আল হাসান যিনি দেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি, তার স্ট্রাইকরেট ১৮.৪। মোস্তাফিজুর রহমানের স্ট্রাইকরেট ১৭.২। অথচ রিশাদের তা ১৬.২। অর্থাৎ কম বলেই তিনি উইকেট তুলে নিচ্ছেন। বোলিং গড়ের দিকেও তিনি অনেক সিনিয়র বোলারদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। শরীফুল, তাসকিন, মেহেদী মিরাজ, শেখ মেহেদী, এমনকি সাকিবের চেয়েও স্ট্রাইকরেটে এগিয়ে রিশাদ। শুধুমাত্র আল-আমিন হোসেনের স্ট্রাইকরেট (১৪.২) তাঁর চেয়ে ভালো, তবে তিনি এখন দলে নিয়মিত নন।
রিশাদের আরও একটি বড় শক্তি হলো মিডল অর্ডার ধ্বংসে তাঁর সক্ষমতা। ওপেনারদের বিপক্ষে তাঁর সাফল্য তুলনামূলক কম হলেও ৩, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ব্যাটারদের বিপক্ষে তিনি ভয়ানক। পরিসংখ্যান বলছে, মিডল অর্ডারে তিনি সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন। ডানহাতি ব্যাটারদের বিপক্ষে ৩৩ বার এবং বাঁহাতিদের বিপক্ষে ১৪ বার আউট করেছেন, যদিও বাঁহাতিদের বিপক্ষে আরও কার্যকর হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানের লেগ স্পিনারদের সঙ্গেও রিশাদকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। রশিদ খান, হাসারাঙ্গা, আদিল রশিদ, ইশ সোধি কিংবা অ্যাডাম জাম্পা—সবাই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্ট্রাইকরেট ও গড়ের মাধ্যমে। রশিদ খানের মতো বিশ্বসেরা লেগ স্পিনার যেখানে প্রতি ১৩.৬ বলে উইকেট নেন, সেখানে রিশাদের ১৬.২ খুব একটা পেছনে নয়। হাসারাঙ্গার মতো স্পিনার যেখানে বোলিং গড় ১৫.৬১ নিয়ে খেলেন, রিশাদও উন্নতির ধারাবাহিকতায় সে জায়গায় পৌঁছাতে পারেন বলেই আশা করা যায়।
ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ ১২২ ইনিংসে শিকার করেছেন ১৩৫ উইকেট। এই তারকা ক্রিকেটারের স্ট্রাইকরেট ১৯.৭ ও বোলিং গড় ২৪.৪৫। ১২০ ইনিংসে ১৩১ উইকেট হাসারাঙ্গার। ১৩.২ বোলিং স্ট্রাইকরেট, বোলিং গড় ১৫.৬১। অ্যাডাম জাম্পার স্ট্রাইকরেট ১৭.০৫ এবং বোলিং গড় ২১.০০। পাকিস্তানের শাদাব খানের বোলিং স্ট্রাইকরেট ১৯.৮ আর বোলিং গড় ২৪.৩৭।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজের কার্যকারিতা প্রমাণ করে দিয়েছেন রিশাদ। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ হোক, পাকিস্তান সুপার লিগ কিংবা গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি—সব জায়গায় নিজের প্রতিভা দেখিয়ে চলেছেন তিনি। তাঁর ঘূর্ণিতে আছে লেগ ব্রেক, টপ স্পিন, ফ্লিপার—সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ প্যাকেজ। তবে ‘গুগলি’ আরও ধারালো হলে, তিনি হয়ে উঠতে পারেন ভয়ংকর প্রতিপক্ষ। বিশ্বমঞ্চে লেগ স্পিনারদের যারা দাপট দেখায়, তাদের কাতারে উঠে আসতে খুব বেশি সময় নিতে হবে না রিশাদ হোসেনকে—যদি তিনি এই ধারাবাহিকতা ও পরিশ্রম ধরে রাখতে পারেন।



