খনন না করায় মাটি জমে ভরাট হয়ে নদীর রূপ হারাচ্ছে মেঘনা। কয়েক দশক আগেও নদীর অধিকাংশ স্থানের গভীরতা ১৫-১৬ হাত ছিল। এখন সেই গভীরতা কমে ২-৩ হাত হয়েছে। এতে একদিকে মৌসুমে কৃষকেরা পানির অভাবে খেতে সেচ দিতে পারেন না, অন্যদিকে বর্ষাকালে নদীর পানি উপচে দুই পারের ফসল তলিয়ে যায়। এ কারণে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মেঘনা নদীর রায়পুরের হাজিমারা সুইজগেইটের পশ্চিমপাড়ের অংশে খননের জন্য সম্প্রতি সার্ভেয়ার করা হয়েছে। ড্রয়িং ঢাকা পাঠাবো। বাজেট হলে প্রায় একমাসের মধ্য প্রকল্প এর কাজ করতে পারবো বলে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শীর্ষ সংবাদকে জানান।
এ পরিস্থিতিতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য স্থানীয় লোকজন নদীটি খনন করার দাবি জানিয়েছেন। এটি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় কৃষকদের পাশাপাশি জেলেরাও বিপদে পড়েছেন। কারণ, আগের মতো নদীতে আর মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয় লোকজন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) লক্ষ্মীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বারাক নদীর উৎপত্তি আসামের লুসাই পাহাড়। সিলেট দিয়ে বাংলাদেশের ঢুকে নাম হয় মেঘনা, যেটা ২ টি শাখা নদীতে বিভক্ত হয় সুরমা এবং কুশিয়ারা নামে। সুরমা এবং কুশিয়ারা আজমিরীগঞ্জে মিলিত হয়ে নাম হয় কালনি, কালনি ভৈরববাজারের নিকট মেঘনা নাম ধারন করে। মেঘনা ভৈরববাজারে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে দক্ষিণ-পশ্চিমে যায়। পদ্মা-মেঘনা চাঁদপুরে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গপোসাগরে পতিত হয়েছে। নদী প্রায় ৩০ কিলোমিটার অতিক্রম করে পদ্মা নদী ও বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এতে মেঘনা নদীর সঙ্গে ডাকাতিয়া নদীর সংযোগ তৈরি হয়েছে। মেঘনা নদী পানি বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল হোসেন হাওলাদার বলেন, আসামের লুসাই পাহাড় থেকে এই মেঘনা নদীর উৎপত্তি। আর সব পানি নিষ্কাশন হতো মেঘনা দিয়ে। সেই নদী এখন মরে গেছে। এখন শুকনো মৌসুমে কৃষক সেচ দিতে নদীতে পানি পান না। অনেক জমি পড়ে থাকে। চাষ হয় না। পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে মেঘনা নদী খনন করতে হবে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, মেঘনা নদী যখন গভীর ছিল, তখন সব জাতের মাছ পাওয়া যেত। একসময় কোরাল, আইর, বড় পাঙ্গাস, চিতল ও বোয়ালের খ্যাতি ছিল। এগুলো এখন স্বপ্ন হয়ে গেছে। ৩০-৪০ বছরে মেঘনা একেবারেই বদলে ভরাট হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধ, মাছ ধরার জন্য বাঁশের খুঁটি স্থাপন এবং ধানের চাষ করায় নদী ভরাট হচ্ছে। এতে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকায় সেচ ও মাছসংকট দেখা দিয়েছে। এই নদীর ওপর নির্ভরশীল এলাকার চরকাছিয়া, জালিয়ার, পাঙ্গাসিয়া, নাইয়াপাড়া, চরইন্দ্রুরিয়া, মিয়ারহাট, হাজিমারা, মোল্লারহাট, হায়দরগন্জসহ অনেক গ্রামের মৎস্যজীবী পরিবার এখন সংকটে পড়েছে।
দক্ষিন চরবংশী ইউনিয়নের চরকাছিয়া গ্রামের বাসিন্দা বর্তমানে রায়পুর শহরে বসবাসকারী আবদুল মাঝি স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আমার ছোটবেলা কেটেছে মেঘনার পাড়ে পাড়ে। নদীর বিভিন্ন স্থানে মধ্যে খানে (গভীর স্থান) ছিল। সেসব স্থানে শুকনা মৌসুমেও ঠাঁই মিলত না। ভয়ে আমরা যেতাম না। আশপাশে বাঁশের চোঙা, হগরা (মাছ ধরার বাঁশের তৈরি ফাঁদ) দিয়ে অনেক বড় বড় মাছ ধরেছি। এখন নদীর দিকে তাকালে খুব কষ্ট হয়।’
উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের-নাইয়াপাড়া গ্রামের জেলে সমিতির নেতা মোস্তফা বেপারি বলেন, ‘নদীর অনেক স্থান ভরাট ও ছোট হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে এবং নদী খনন না করা হলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে নদী মরা খাল পরিণত হবে।’
উত্তর-চরবংশী ইউপির নাইয়াপাড়া গ্রামের নদীতে মাছ ধরেন ফরহাদ হোসেন বলেন, ২০ বছর আগে সারা বছর মাছ ধরেছেন। এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। পলি মাটি জমেছে, খনন খুবই জরুরী।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন. বলেন, দীর্ঘকাল ধরে এ দেশে নদীর পানিতেই চাষাবাদ হতো। নদীগুলো পনিশূন্য হয়ে পড়ায় বিকল্প সেচব্যবস্থা করতে হয়েছে। এতে শুধু সেচ খরচই বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
মেঘনা ও ডাকাতিয়া সুরক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান শীর্ষ সংবাদকে বলেন, ‘খনন না করায় জেলার অনেক নদীই মরে যাচ্ছে। মেঘনার অবস্থাও করুণ। এখনই খননের উদ্যোগ না নেওয়া হলে এঅঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে।
পাউবো লক্ষ্মীপুর কার্যালয়ের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (রায়পুর) ইমতিয়াজ মাহমুদ শীর্ষ সংবাদকে বলেন, ‘মেঘনা নদীর রায়পুরের হাজিমারা সুইজগেইটের পশ্চিমপাড়ে অংশে খনন করে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। খননের জন্য সম্প্রতি সার্ভেয়ার করা হয়েছে। ড্রয়িং ঢাকা পাঠাবো। বাজেট হলে প্রায় একমাসের মধ্য প্রকল্প এর কাজ করতে পারবো।’