লক্ষ্মীপুর সদরের মেঘনা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের প্রায় ৮০টি পরিবারের বসবাস। পরিবারগুলো হাড়কাঁপানো শীতে কাঁপছে। জেঁকে বসা শীতের কারণে তারা টানা ১০ থেকে ১২দিন মাছ ধরতে যেতে পারেননি। যার কারণে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারি-বেসরকারি ও সেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলো তাদের পাশে এগিয়ে আসেনি।
জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার তাগিদে এসব মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নৌকায় বসবাস করেন। এজন্য তারা ‘মানতা’ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত।
‘মানতা’ এমন একটি জনগোষ্ঠী তাদের নৌকায় বসবাস। জন্ম নৌকায়, বেড়ে ওঠা নৌকায়, বিয়ে নৌকায়, জীবন সংসার কাটে নৌকায়। অবশেষে মৃত্যুও হয় নৌকায়।
একসময় তাদের পূর্বপুরুষের সবকিছুই ছিল নদীর তীরবর্তী এলাকায়। ক্রমাগত নদীভাঙনে নিঃস্ব হতে হতে এরা এখন নৌকার বাসিন্দা। এক একটি নৌকা এক একটি পরিবার। নৌকার মাঝখানে ঘুমানোর স্থান, পেছনের অংশে রান্নাবান্না আর খাওয়া-দাওয়া এবং সামনের অংশে কাজকর্ম। ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের আয়ের উৎস মাছধরা। পরিবারের সবাই মিলে নদীতে মাছ ধরতে যান। মাছধরা শেষে আবার কিনারে নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে আসে। এরা দল বেঁধে বিভিন্ন এলাকায় বাস করে।
ঝড়-তুফান, হাড়কাঁপানো শীত সবকিছুই তাদের নিত্যসঙ্গী। তারা সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
সরেজমিনে গিয়ে সদর উপজেলার মজুচৌধুরী হাট এলাকায় ‘মেঘনাপাড় ধীবর বিদ্যানিকেতন স্কুল’ সংলগ্ন এলাকায় গেলে নদীর তীরে সারি-সারি ছোট-বড় অনেক নৌকা বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়। সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, খুব দুঃখ-কষ্ট নিয়ে এ শীতে বেঁচে আছে। কেউ তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন না। এ শীতে একটি কম্বলও পাননি। ১০ থেকে ১২ দিন তারা মাছ শিকারে নদীতে যেতে পারেননি। এতে তাদের সংসার চালাতে খুব হিমশিম খেতে হচ্ছে।
৭০ বছর বয়সী বকুল বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ২ ছেলে ৪ মেয়ে রেখে তার স্বামী শামসুল মাঝি মারা যান কয়েক বছর আগে। তিনি বর্তমানে তার মেজ মেয়ে নাজমা বেগমের সঙ্গে বসবাস করেন একটি নৌকায়।
আছমা বেগম বলেন, অনেক শীত পড়ছে। খুব ঠান্ডা লাগে। নদীতে তেমন একটা মাছ ধরা হয় না। সংসার সামলাতে খুব হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেমন বাতাস তেমনই কুয়াশা।
ফাইমা নামে এক তরুণী বলেন, যেমন শীত তেমনি বাতাস। খুব কষ্টে আমরা বেঁচে আছি। কেউ আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করেন না। নানি ও খালাম্মাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে মাছ ধরতে নদীতে যাই।
সুখিয়া বেগম বলেন, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে নৌকায় বসবাস করছি। বাস্তবতার সঙ্গেই আমাদের জীবনযাত্রার মান একেবারে আলাদা। এ কয়েকদিন কেউ আমার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন না। একসময় ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতাম। গত কয়েকদিন ধরে নদীতে যাওয়া সম্ভব হয় না। প্রচুর বাতাস। খুব ঠান্ডা পড়ে। গরম পোশাকও নেই। আমাদের আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।
‘মানতা’ জনগোষ্ঠীর (সর্দার) সৌরভ মাঝি বলেন, এক সময় আমাদের এ গ্রুপে ১২০টি পরিবারের বসবাস ছিল। বর্তমানে ৮০টি পরিবারের বসবাস। বাকি ৪০ পরিবার শেখ হাসিনার দেওয়া উপহার পাবে। কেউ আমাদের সহয়তা করেন না। বাতাস বাড়লে শীতও জেঁকে বসে। আমরা অনেক কষ্টে আছি।
জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, খুব শিগগিরই মজুচৌধুরী হাট এলাকায় পরিদর্শন করা হবে এবং তাদের মাঝে চাল ও শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।
‘মানতা’ সম্প্রদায়ের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা অতীতেও ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের মাঝে বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করছি। সামনেও করা হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসন সবসময় অসহায় মানুষের পাশে থেকে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে।