মহাকালের আবর্তে বিলীন হয়েছে ২০২২ সাল, স্বাগত নতুন বছর ২০২৩ সাল। গেল বছরের সকল দুঃখ-বেদনা ভুলে মধ্যরাতের পর থেকে বিশ্বের সাথে বাংলাদেশও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নতুন আশা নিয়ে বরণ করে নিতে শুরু করেছে ২০২৩ সালকে। বিশ্বজুড়ে এবারও কোটি কোটি মানুষ নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে।
‘ইংরেজি নববর্ষ-২০২৩’ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা অনুযায়ী ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন আজ। ২০২৩ সালের প্রথম দিন। নতুন বছরটি যেন প্রতিটি মানুষের মন থেকে সব গ্লানি, অনিশ্চয়তা, হিংসা, লোভ ও পাপ দূর করে। গত বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব খুঁজতে খুঁজতে নতুন বছরকে সামনে রেখে আবর্তিত হবে নতুন নতুন স্বপ্নের।
আরও পড়ুন- উন্মুক্ত স্থানে থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান নয়
এদিকে, কোভিড-১৯ মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি এখনো অস্থিতিশীল। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতা কাটেনি। অন্যদিকে ভাটা পড়েছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে। রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। এ ধরনের নানা সংকট নিয়ে আজ শুরু হচ্ছে নতুন ইংরেজি বছর ২০২৩। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৩ সাল হবে বাংলাদেশের সংকট মোকাবিলার বছর।
গেল বছর সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার বড় কারণ ছিল মূল্যস্ফীতি। নতুন বছরেও তাই। সঙ্গে আছে আরও কিছু আশঙ্কা রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে, আমদানি করা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে, কমে যেতে পারে রেমিট্যান্সও। বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়লে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যেতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়।
গত আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছিল। ওই মাসে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল দেশে; খাদ্য মূল্যস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছিল প্রায় ১০ শতাংশে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে অবশ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবর ও নভেম্বরে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯১ এবং ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ফলে আগামী বছরেও মূল্যস্ফীতির উত্তাপ থাকবে।
আরও পড়ুন- ‘বিচার নিশ্চিতে যা যা প্রয়োজন, সব করেছে বর্তমান সরকার’
বিদায়ী বছরে ব্যাংক খাতে আলোচিত ঘটনা ছিল ডলার সংকট। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় এই সংকট তীব্র হয়। তাতে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে ১০৫ থেকে ১০৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নতুন বছরেও ডলার সংকট থাকতে পারে।
ডলার সংকট সামাল দিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন তা কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল চাঙ্গা হওয়ায় বিদায়ী বছর দেশে প্রবাসী আয় ১০০ কোটি ডলার কমবে বলে বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই প্রবাসী আয় ১৬০ কোটি ডলারের নিচে ছিল। গত মাসের প্রথম ২৩ দিনে (১-২৩ ডিসেম্বর) দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১২৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার। অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স প্রবাহে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও অর্থবছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি থাকবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে।
যাইহোক, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত ২০২২ বিদায় নিল। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও মেট্রোরেলের মতো বৃহৎ অবকাঠামো উদ্বোধন এবং জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়, এসব কারণে ২০২২ সাল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। নতুন বছরে অগ্রগতির পথে সব জটিলতা দূর হবে— এটাই সবার প্রত্যাশা। মহামারির ধাক্কা সামলে নিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাক।
আরও পড়ুন- প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত
রাজনৈতিক যোগ-বিয়োগ, ধর্মীয় সম্প্রীতি-সহিংসতা, আন্তর্জাতিক শুভ-মন্দ ঘটনার প্রেক্ষাপটে হোঁচট খেলেও আবারও উঠে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিপদসঙ্কুল পথেই দীপ্ত পায়ে হেঁটেছে। বিদায়ী বছরের পূর্ব মুহূর্তে চলে সালতামামির আয়োজন। হিসেব-নিকেশ, চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে মাসজুড়ে। যা কিছু ঘটেছে, তা আমাদের চোখের সামনেই। চোখ বুজলেই তা দেখতে পাই। তবুও স্মরণ করিয়ে দেওয়া, একটু আলোড়িত করা। কবির ভাষায়, ‘রূপ রস ও গন্ধময়/পৃথিবী হতে বিদায় লয়/ পুরাতন বর্ষ শেষ হয়।’
পুরাতনকে হাসিমুখেই বিদায় দিতে প্রস্তুত দেশ। প্রস্তুত শেষ রজনী উদযাপনে। স্বাগত জানাব নতুন সূর্যকে। বাংলার সর্বস্তরের মানুষের জন্য শুভময় সফলতম বছর আসুক—এ প্রার্থনা করবে সব ধর্মের মানুষ। সবশেষেও বলতে হয়, ‘মুকুলিত সব আশা/স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা/জীবনে চির স্মৃতি হয়ে রয়, পুরাতন বর্ষ বিদায় লয়।/নববর্ষের আগমন হয়।’ সব আশা-স্নেহ-ভালোবাসা স্মৃতি হয়ে থাকুক। আগামী আসুক পুষ্পশোভিত হয়ে। প্রজ্বলিত সূর্যের আলোকচ্ছটায় আলোকিত হোক বিশ্ব। বিশ্বের যাবতীয় মানুষের কল্যাণ হোক। বাংলাদেশ উত্তরোত্তর সফলতার দিকে এগিয়ে যাক। বিদায় ২০২২, স্বাগত ২০২৩।
নববর্ষ মানেই সকলের মাঝে জাগায় প্রাণের নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। বিগত বছরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পেছনে ফেলে নতুন বছরে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়া।